ভারতবর্ষে মৌর্য পরবর্তী যুগে যে সমস্ত সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তার হয়েছিল তাদের মধ্যে কুষাণ সাম্রাজ্য ছিল অন্যতম। এই কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের কৃতিত্ব (Achievements of Kanishka) ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পরবর্তী যুগে কুষাণ সাম্রাজ্য শিল্প ও সংস্কৃতির দিক থেকে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। তাছাড়া উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কুষাণদের আধিপত্য বিস্তার হয়েছিল। কারণ কুষাণ রাজারা বিশেষ করে কনিষ্ক ভারতে বৈদেশিক আক্রমণের ধারাবাহিকতাকে বন্ধ করেছিলেন।
কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের কৃতিত্ব | Achievements of Kanishka
ভারতবর্ষের কুষাণ সাম্রাজ্যের কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের কৃতিত্ব ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় কদফিসিস -এর পর কনিষ্ক কুষাণ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। সাধারণভাবে কনিষ্ক ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি বহু রাজ্য জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেন।
কনিষ্ক (Kanishka)
কনিষ্কের শাসনকাল সম্পর্কে বিতর্কিত থাকলেও সাধারণত ৭৮ খ্রিস্টাব্দে কনিষ্ক সিংহাসনে বসেন। কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের কৃতিত্ব যে সমস্ত দিকে বিস্তৃত তা এখানে আলোচনা করা হল –
1. রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তার
সমকালীন বিভিন্ন লিপি, মুদ্রা ও বৈদেশিক সাহিত্য থেকে জানা যায় কনিষ্ক অসাধারন যুদ্ধনীতি ব্যবহার করে বহু রাজ্য জয় করেন এবং বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে ওঠেন। রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কাশ্মীর কনিষ্কের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ মনে করেন কনিষ্ক চীনকে পরাজিত করে কাশগড়, খোটান, ইয়ারখন্দ দখল করেন। তাছাড়া, উনিশের রাজ্যসীমা উত্তরের খোটান থেকে দক্ষিণের মহারাষ্ট্র পর্যন্ত এবং পশ্চিমে খোরাসান থেকে পূর্বে বেনারস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
কনিষ্কের সাম্রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুরুষপুর। বর্তমানে এটি পাকিস্তানের পেশোয়ার অন্তর্গত।
2. শকাব্দের প্রচলন
বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ মনে করেন কনিষ্কের সময় থেকে শতাব্দ বা নতুন বর্ষগণনা শুরু হয়। শকাব্দ পদ্ধতিতে বর্ষগননা ভারতে সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তবে কনিষ্কের শকাব্দ প্রবর্তনের ইতিহাস একটি বিতর্কিত বিষয়।
3. বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ
বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বিকাশের জন্য কনিষ্কের অবদান পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ কনিষ্ক নিজে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার সাধন করেন।
কনিষ্কের শাসনকালে “চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি” নামে বৌদ্ধ মহাসম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই মহাসম্মেলনে বা ধর্ম সভায় মহাযান ধর্মমত স্বীকৃত লাভ করে। তাছাড়া কনিষ্কের প্রচেষ্টায় চীনে ও পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। তবে কেবলমাত্র বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার নয় কনিষ্ক হিন্দু গ্রিক ও পারসিক দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন।
4. সাংস্কৃতিক বিকাশ
কনিষ্কের শাসনকালে সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির বিপুল অগ্রগতি ঘটে। তাছাড়া ভাস্কর্য শিল্পে কনিষ্কের শাসনকালে অসামান্য অবদান পাওয়া যায়। এই সময়কালে ভাস্কর্য শিল্পে গান্ধার রীতি ও মথুরা রীতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারগুলিকে কেন্দ্র করে এই রীতি মেনে স্থাপত্য শিল্পগুলি গড়ে উঠেছিল।
বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, কনিষ্কের শাসনকালে কনিষ্ক পুরুষপুর বা পেশোয়ারে বুদ্ধের বিখ্যাত শিল্পকলা চিত্রটি নির্মিত হয়। তাছাড়া কনিষ্কের শাসনকালে অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়।
শিল্পের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রে কুষাণ যুগের বা কনিষ্কের শাসনকালে অসামান্য অবদান পাওয়া যায়। অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, বসু মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাবে কুষাণ যুগের সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- পণ্ডিত অশ্বঘোষের রচিত গ্রন্থ হল বুদ্ধচরিত।
- দার্শনিক নাগার্জুন বৌদ্ধ ধর্মমতের ব্যাখ্যা করেন। নাগার্জুনের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল প্রজ্ঞা-পারমিতা সূত্র।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, বিভিন্ন সংস্কারধর্মী কাজে কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের অবদান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ঐতিহাসিকবিদগণ কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের পর্যালোচনা করলেও কনিষ্কের রাজত্বকাল ছিল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস একটি গৌরবময় ও সৃজনশীল পর্ব।
তাছাড়া কনিষ্ক তাঁর রাজত্বকালে বৈদেশিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে মধ্য এশিয়া তথা উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এক ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। সুতরাং রাজনৈতিক স্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কনিষ্ক বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Achievements of Kanishka
- Online Sources
প্রশ্ন – কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক কে ছিলেন তার রাজধানী কোথায় ছিল
উত্তর – কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কনিষ্ক। কনিষ্কের রাজধানী ছিল পুরুষপুর, বর্তমানে এটি পাকিস্তানের পেশোয়ার মধ্যে অবস্থিত।
প্রশ্ন – কনিষ্ক কি উপাধি নিয়েছিলেন
উত্তর – বিভিন্ন শিলালিপি ও ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে সম্রাট কনিষ্ক কি উপাধি নিয়েছিলেন তা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন – মহারাজাধিরাজ (রাজাদের রাজা), ধর্মরাজ (বৌদ্ধ ধর্মে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তিনি ধর্মরাজ উপাধি নেন), ও দেবপুত্র উপাধি।
প্রশ্ন – কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে
উত্তর – কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কনিষ্ক।
প্রশ্ন – কনিষ্ক কত খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন
উত্তর – কনিষ্ক আনুমানিক 78 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। ঐদিন থেকেই শকাব্দ বা নতুন বর্ষগণনা শুরু হয়
প্রশ্ন – কনিষ্কের রাজধানী কোথায় ছিল
উত্তর – কনিষ্কের রাজধানী ছিল পুরুষপুর, বর্তমানে এটি পাকিস্তানের পেশোয়ার মধ্যে অবস্থিত।
প্রশ্ন – কনিষ্কের সভাকবি কে ছিলেন
উত্তর – কনিষ্কের সভাকবি ছিলেন পন্ডিত অশ্বঘোষ এবং বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution
- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রশ্ন উত্তর | Fort William College Quiz Question and Answers
- বাংলা গদ্য সাহিত্যে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান | Contribution of Serampore Mission to Bengali Prose
- বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose
- বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা | Vidyasagar Contribution to Bengali Literature
- বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature