খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। বিভিন্ন গুপ্ত রাজাদের মধ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কার্যাবলী (Achievements of Chandragupta 2) বা কৃতিত্ব ছিল অসামান্য প্রকৃতির।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কার্যাবলী | Achievements of Chandragupta 2
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের পাঁচ শতক ধরে কোনো ঐক্যবদ্ধ ও সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির ছিল না। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে কুষাণ ও সাতবাহন রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপর গুপ্ত রাজাদের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। ঐতিহাসিকগন একে গুপ্ত সাম্রাজ্য হিসেবে গণ্য করেন।
গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রাজত্বকাল ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কার্যাবলী বা কৃতিত্ব যে সমস্ত দিক থেকে লক্ষণীয় সেগুলি আলোচনা করা হলো।
1. সাম্রাজ্য বিস্তার
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উন্নতি চরম শিখরে পৌঁছায়। গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রাজ্য বিস্তার নীতির ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেন। সেগুলি হল –
- বৈবাহিক সম্বন্ধ নীতি
- শত্রুপক্ষের সঙ্গে সন্ধি নীতি এবং
- যুদ্ধ বিজয় নীতি
সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মালব, গুজরাট ও কাথিয়াবাড়ের শক রাজাদের পরাজিত করে আরব সাগর পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
তিনি প্রথমে পশ্চিম ভারতের শেষ শক ক্ষত্রপ ও তৃতীয় রুদ্রসেনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কয়েক বছর যুদ্ধ চলার পর তিনি তৃতীয় রুদ্রসেনকে পরাজিত করেন। এইভাবে শক বংশের অবসান ঘটে এবং পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত হয়।
2. রাজধানী স্থাপন
গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক বংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে ‘শকারি’ উপাধি গ্রহণ করেন। এবং পরবর্তীকালে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী নগরীতে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন।
3. বিশ্ব বিজেতা
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে সমসাময়িক কিছু লেখাতে বিশ্ব বিজেতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দিল্লির নিকটে মেহেরৌলিতে একটি সুপাচীন লৌহ স্তম্ভ থেকে জানা যায় যে, চন্দ্র নামে এক রাজা বাংলার নিপতীদের পরাজিত করেন এবং সেখান থেকে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে ব্যাকটিয়ায় অভিযান চালান।
আবার বিশিষ্ট ঐতিহাসিকবিদ ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন – এই দিগ্বিজয়ী নিপতিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলে মনে করা হয়।
4. বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে অনেকে কিংবদন্তির বিক্রমাদিত্য বলে মনে করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রবর্তিত মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য কথাটি উল্লেখ আছে। তাই কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্যের উপাধি ছিল শকারি।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রাজত্বকালে নবরত্ন সভা গঠিত হয়েছিল। এই সভাতে কবি কালিদাস ছিলেন অন্যতম বিশিষ্ট সভাকবি। অর্থাৎ কবি কালিদাস দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকে আলোকিত করে তুলেছিলেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন – নবরত্নের সব পন্ডিত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা অলংকৃত করেননি।
5. কুষানদের বিরুদ্ধে অভিযান
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আফগানিস্তানের কুষাণদের বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন এবং কুষাণদের বিদ্রোহ দমন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তবে কুষাণদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ওই অঞ্চলের সামরিক সাফল্য লাভ করেছিলেন এ কথা জানা যায়।
6. ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শাসনকালে ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছিল একথা অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কালে গুপ্ত সাম্রাজ্য পূর্ব বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ফলে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। তাছাড়া ঐতিহাসিকগণ মনে করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রোমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণী থেকে জানা যায় – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে পূর্ব উপকূলে অবস্থিত তাম্রলিপ্ত এবং পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সোপারক ছিল বাণিজ্যের প্রধান বন্দর ও কেন্দ্রবিন্দু।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্থান ছিল সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্বের পরে। অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের উত্তরসূরি। তাই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যকে পরিপূর্ণতা দান করেন। কেবলমাত্র শাসক হিসেবে নয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে খ্যাতি ও অমরত্ব লাভ করেছিল। তাই চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Achievements of Chandragupta 2
- Online Sources
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল
উত্তর – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল হল ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্রের নাম কি
উত্তর – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্রের নাম হল কুমার গুপ্ত। তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর মহেন্দ্রাদিত্য উপাধি নিয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন।
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উপাধি কি ছিল
উত্তর – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উপাধি ছিল শকারি। আবার অনেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে কিংবদন্তির বিক্রমাদিত্য বলে মনে করতেন। তাছাড়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রবর্তিত মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য কথাটি উল্লেখ আছে।
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি কে ছিলেন
উত্তর – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় নবরত্ন ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম সভাকবি ছিলেন কবি কালিদাস।
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজধানীর নাম কি
উত্তর – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। তবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। যা অর্থনৈতিক উন্নতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিগণিত হয়।
প্রশ্ন – দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কি বিক্রমাদিত্য ছিলেন?
উত্তর – বিভিন্ন ঐতিহাসিকবিদগণের মতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে বিক্রমাদিত্য বলা হয়। কারণ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রবর্তিত বিভিন্ন মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য কথাটি খোদাই করা রয়েছে।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কার্যাবলী আলোচনা | Achievements of Chandragupta 2 সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।