ভক্তি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা | Bhakti Movement of India

দ্বাদশ শতকের ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলন (Bhakti Movement of India) -র উৎপত্তি হলেও পরে উত্তর ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ভক্তি আন্দোলন | Bhakti Movement of India

দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, রক্ষণশীলতা, বর্ণবৈষম্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে ভক্তি ধর্ম আন্দোলন (Bhakti Movement of India) -র সূচনা হয়। সুলতানি যুগে ভক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ভক্তি শব্দের অর্থ হল – ভজনা অর্থাৎ ঈশ্বরের নাম গান করা।

ভক্তিবাদের মূল কথা হলো – অন্তরের পবিত্রতা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং এক ঈশ্বরে বিশ্বাস। দক্ষিণ ভারতের ভক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও পরবর্তীকালে ভক্তি আন্দোলন উত্তর ভারতের জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তাগন হলেন কবীর, রামানন্দ, নামদেব, গুরু নানক এবং মহাপ্রভু শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব, সুরদাস, দাদূ প্রমূখ।

Bhakti Movement Pictures

A) রামানন্দ

সুলতানি আমলে উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হলেন রামানন্দ। রামানন্দের জন্ম প্রয়াগে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। রামানন্দের ভক্তি আন্দোলনের মূল বাণী ছিল – “শ্রী রামচন্দ্রই ঈশ্বর – তার প্রতি অবিচল ভক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে”।

রামানন্দ জাতিভেদ প্রথা মানতেন না। তাই তিনি হিন্দু ধর্মের যাবতীয় অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার এবং আচার অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধিতা করতেন।

B) কবীর

রামানন্দের অন্যতম শীর্ষ ছিলেন কবীর। তিনি মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের প্রধানতম সাধক ছিলেন। তিনি হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়ের ডাক দিয়েছিলেন। ধর্মীয় রীতিনীতি ও বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান তিনি মানতেন না।

তাছাড়া তিনি জাতিভেদ প্রথা, মূর্তি পূজা এবং নামাজ পড়ার বিরোধিতা করতেন। কবীর তাঁর উপদেশগুলি হিন্দি ভাষায় ছোট ছোট কবিতা বা দোঁহার মাধ্যমে প্রচার করতেন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডক্টর তারাচাঁদের মতে – ‘সর্বধর্ম সমন্বয় এবং মানব প্রেমের বাণী প্রচার ছিল কবীরের মূল লক্ষ্য’।

C) মহাপ্রভু শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ভক্তিবাদের তথা বৈষ্ণবধর্মের বিকাশ ঘটে। শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব মহাপ্রভু ছিলেন এই বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম প্রবর্তক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর লাভ করা যায়। তাই চৈতন্যদেবের মূল কথা ছিল – বৈরাগ্য, জীবে দয়া ও শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেম।

চৈতন্যদেব জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথার ঘর বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি অহিংসাকে পরম ধর্ম বলে মনে করতেন। তাই তিনি জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষকে শান্তির মহৎ বাণী প্রচার করেছিলেন।

বিশিষ্ট ভাষাবিদ সুকুমার সেন চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনকে “বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ” বলে অভিহিত করেছেন।

ভক্তি আন্দোলনের কারণ

ভারতবর্ষের ভক্তি আন্দোলনের হিসাবে তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি অনেকাংশে দায়ী ছিল। সাধারণভাবে ভক্তি আন্দোলনের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল –

1. সামাজিক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার

ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম কারণ হল হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়।

2. ধর্মান্ধতা

ভক্তি আন্দোলনে অন্যতম কারণ হিসেবে ধর্মান্ধতাকে দায়ী করা হয়। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় বিভেদ বা বিভাজনের ফলে উক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

3. বর্ণ বৈষম্য

সমাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদ ভক্তি আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে। গুরু নানক, চৈতন্যদেব, রামানন্দ সকলেই ধর্মীয় বিভেদ ভুলে সমন্বয়ের কথা প্রচার করেন। তাই তারা পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব

দ্বাদশ শতকে শুরু হওয়া ভারতবর্ষে ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল –

i) ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অস্পৃশ্যতা ও ব্যভিচারের পরিবর্তে মানুষ ও সরল জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়।

ii) ভক্তি আন্দোলন একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মের গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, অন্যদিকে ভক্তি আন্দোলনের ফলে হিন্দু সমাজে সংহতি ও ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল।

iii) ভক্তি আন্দোলনের ফলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমন্বয় সাধন হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে চলা বিবাদ ও সংঘর্ষ ভক্তি আন্দোলনের ফলে অবসান ঘটে এবং সাময়িকভাবে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়।

iv) ভক্তি আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। যেমন – রামানন্দ কবিরের রচনা হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। অপরদিকে চৈতন্যদেবের শীষ্যগণ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। আবার নানকের দ্বারা পাঞ্জাবি ভাষাও সমৃদ্ধি লাভ করে।

v) ভক্তি আন্দোলনের ফলে নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ভক্তি আন্দোলনকারীরা সমাজে নারী পুরুষদের ভেদাভেদ করতেন না। তাছাড়া মেয়েরা ধর্ম সভায় যোগদানের অধিকার ফিরে পান।

উপসংহার

সর্বোপরি বলা যায়, ভক্তি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, বর্ণভেদ, ধর্মভেদ প্রভৃতির দূরীকরণ করা। তাই ভক্তি আন্দোলনের মানবতাবাদী সাধু সন্তুরা , হিন্দু ধর্মের বর্ণভেদ প্রথার কিছু পরিবর্তন করতে না পারলেও তাঁর বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কঠোরতাকে অনেকাংশে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছিল।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • Bhakti Movement of India
  • Online Sources

প্রশ্ন – ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক কে

উত্তর – ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক হিসেবে কবীর, রামানন্দ, নামদেব ও শ্রীচৈতন্যদেব প্রমূখ জনপ্রিয়।

আরোও পোস্ট পড়ুন

ভক্তি আন্দোলন | কারণ ও প্রভাব | Bhakti Movement of India সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment