মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Administration of Mauryan Empire

ভারতবর্ষের ইতিহাসে মৌর্য শাসন ব্যবস্থা (Administration of Mauryan Empire) ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সর্বপ্রথম মৌর্য সম্রাটগণ উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জয় করে মৌর্য সাম্রাজ্যের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা | Administration of Mauryan Empire

প্রাচীন ভারতে মৌর্য যুগ ছিল অন্যতম যুগ সন্ধি। বিভিন্ন মৌর্য সম্রাট যেমন – চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার, সম্রাট অশোক সর্বপ্রথম উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জয় করে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। মেগাস্থিনিস এর বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ, জুনাগড় শিলালিপি ও অশোকের শিলালিপি থেকে মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়।

Administration of Mauryan Empire in India

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা (Administration of Mauryan Empire) কেমন ছিল, তা এখানে আলোচনা করা হলো।

1. কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রচলন ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রধান হলেন রাজা। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান শাসক, ধর্ম রক্ষক, বিচারপতি এবং আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। ভিনসেন্ট স্মিথ মৌর্য সাম্রাজ্যের বংশানুক্রমিক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে বলগাহীন স্বৈরতন্ত্র নামে অভিহিত করেন। তবে মৌর্য শাসকেরা কখনো সীমাহীন স্বৈরাচারী ছিলেন না, তারা নিজেদেরকে ‘ দেবনাং প্রিয়’ বলে অভিহিত করতেন।

2. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। অর্থাৎ সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা হয়। এগুলি হল – প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণা পথ। পরবর্তীকালে অশোক কলিঙ্গ জয় করলে মৌর্য সাম্রাজ্যের মধ্যে কলিঙ্গ প্রদেশ সংযোজিত হয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থায় শাসনকর্তাদের ‘প্রাদেশিক’ বলা হত। প্রদেশ গুলি যথাক্রমে জেলা ও গ্রামে বিভক্ত ছিল। জেলার দায়িত্বে থাকতেন সমাহর্তা নামে অ্যাকশনের কর্মচারী এবং গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন গ্রামিক নামক কর্মচারী। প্রাদেশিক প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ রাজ পুরুষেরাই নিযুক্ত হতেন।

3. মন্ত্রী পরিষদ

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা ঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মৌর্য সম্রাটগণ আনাস্তরের রাজকর্মচারীদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এদের বলা হতো আমত্য বা সচিব। এই সচিবদের মধ্যে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হতো। মন্ত্রীগণ প্রশাসন, পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজাকে সুপরামর্শ দিতেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন এই মন্ত্রীদের বেতন ছিল বার্ষিক ৪৮ হাজার পান।

4. নগর প্রশাসন

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় নগর বা শহরগুলি প্রত্যক্ষভাবে শাসিত হতো। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় – ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের ওপর নগর প্রশাসনের শাসনভার ন্যস্ত ছিল। নগর পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য নিয়ে ছয় ধরনের পৃথক সমিতি গঠিত ছিল। এদের কাজ হল জন্ম মৃত্যুর হিসাব সংরক্ষণ, ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, কর আদায়, শিল্প কার্যের তত্ত্বাবধান প্রভৃতি।

5. সামরিক সংগঠন

গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস এর বিবরণ থেকে জানা যায় মৌরু সাম্রাজ্যের সামরিক সংগঠন ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের বিশাল সামরিক সংগঠন ছিল। অনুমান করা হয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীতে ছয় লক্ষ পদাতিক বাহিনী, ৩০ হাজার অস্বারী বাহিনী, নয় হাজার হাতি ও প্রচুর পরিমাণে রথ ছিল। এই সামরিক সংগঠন পরিচালনার জন্য সামরিক পরিষদের উপর দায়িত্ব ছিল।

6. গুপ্তচরের ব্যবস্থা

মৌর্য যুগে সামরিক সংগঠনের পাশাপাশি গুপ্তচর ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট উন্নত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে মৌজা সাম্রাজ্যের তিন প্রকারের গুপ্তচর বাহিনীর পরিচয় পাওয়া যায়। যথা – সমস্থা, সঞ্চরা ও পরিদর্শক। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর বিখ্যাত ‘History of India’ নামক শীর্ষক গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্যের গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন।

7. বিচার ব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বিচার ব্যবস্থা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কোনো অপরাধীদের জন্য বিচার ব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ এবং কঠোর প্রকৃতির। মৌর্য সম্রাটগণ নিজেরাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারক ছিলেন। তাছাড়া গাম এবং শহরের বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব ছিল গ্রামীণ ও নগর ব্যবহারিকদের।

8. রাজস্ব ব্যবস্থা

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় মৌর্যযুগে ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায় ব্যবস্থা ছিল। তাছাড়া মৌর্য যুগের রাষ্ট্রই ছিল জমির মালিক। বলি ও ভাগ – এই দুই ধরনের খাজনা আদায় করা হত। ভূমির রাজস্বের পরিমাণ ছিল এক চতুর্থাংশ। তাছাড়া বাণিজ্য শুল্ক, জন্ম ও মৃত্যু কর, জল কর, পথ কর প্রকৃতি কর হিসেবে আদায় করা হতো।

9. সম্রাট অশোকের শাসনব্যবস্থার সংস্করণ

কলিঙ্গ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সম্রাট অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা আর কিছু পরিবর্তন আনেন ও শাসন ব্যবস্থাকে জনকল্যাণমুখী চরিত্র দান করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি যুত, রাজুক, মহাপাত্র, প্রাদেশিক, নগর ব্যবহারিক, প্রতিবেদক নামক কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। তাছাড়া অশোকের আমলে প্রজাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য নানারকম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।

উপসংহার

সর্বপরি বলা যায়, মৌর্য যুগে ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠন ও শাসন কাঠামো প্রবর্তিত ছিল। তবে মৌর্য শাসনব্যবস্থার মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। যেমন – আমলাতন্ত্রের প্রভাব বেশি থাকায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। তাছাড়া বিশাল সাম্রাজ্যের সুষ্ঠুভাবে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা সহজ ছিল না বরং বেশি খরচ সাপেক্ষ ছিল। তাই ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার মনে করেন – বিশাল প্রশাসনের ড্রাইভার নির্বাচনের জন্য অর্থনৈতিক সংকট মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। এইসব দোষ ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে মৌর্য শাসন ব্যবস্থা এক অন্যতম নজির সৃষ্টি করেছিল।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • Administration of Mauryan Empire in India
  • Online Sources

প্রশ্ন – মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি লেখো

উত্তর – মৌর্য শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল – সুপরিকল্পিত কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা। এছাড়া আইন ও বিচার ব্যবস্থা কঠোর প্রকৃতির ছিল এবং গুপ্তচর -এর মাধ্যমে রাজ্যের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল।

প্রশ্ন – মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে

উত্তর – মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন সম্রাট অশোক। তাই বিভিন্ন ঐতিহাসিকবিদগণ সম্রাট অশোক্ষে সর্বকালের এবং সর্ব দেশের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছে।

আরোও পোস্ট পড়ুন

Leave a Comment