অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে ফলে অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি বস্ত্রশিল্পের উত্থান ঘটে এবং নীল চাষের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই নীল চাষকে কেন্দ্র করে নীল বিদ্রোহের (Blue Rebellion) কারণ বা সূচনা ও গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়।
নীল বিদ্রোহের কারণ | Causes of the Blue Rebellion
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে বস্ত্রশিল্পের উত্থান ঘটে। এই বস্ত্র শিল্পের বিস্তার ঘটনার জন্য নীল ও নীল চাষের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। তাই অধিক মুনাফা লাভের জন্য ব্রিটিশ সরকার অষ্টাদশ শতকে ভারতীয় নীল চাষীদের উপর বিভিন্ন রকম ভাবে অত্যাচার চালায়। যার ফলস্বরূপ ১৮৫৯ সালে নীল চাষীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহ মূলত নীল চাষকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হলেও এর পশ্চাতে আরো বিভিন্ন কারণ ছিল। তাই নীল বিদ্রোহের কারণ গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল –
1. নীলকর সাহেবদের অত্যাচার
নীল চাষের জন্য নীলকর সাহেব তথা ইংরেজরা সাধারণ গরিব নীল চাষীদের উপর অত্যাচার। এমনকি তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত এবং বাড়ির মহিলাদের সম্মানহানি। ফলে এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে নীল চাষের একত্রিত হয়ে নীল বিদ্রোহ শুরু করে।
2. দাদন প্রথা
দাদন প্রথা নীল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। অর্থাৎ অনিচ্ছুক কৃষকেরা নীল চাষ করতে না চাইলে জোর করে তাদেরকে নীল চাষ করতে বাধ্য করা হয়। তাই একবার দাদন নিলে নীল চাষীরা আর রেহাই পেত না।
3. কৃষকদের সঠিক মুনাফা না দেওয়া
নীল চাষের ফলে যে মুনাফা বা লাভ হতো তা নীলকর সাহেবরা বেশিরভাগ অংশ নিয়ে নিত। অর্থাৎ কৃষকদের খাটিয়ে নিয়ে সঠিক মুনাফা দিত না। ফলে তাদের মধ্যে অভাব অভিযোগ দেখা দিতে থাকে। এর ফলে নীল বিদ্রোহের সূচনাকে অগ্রগতি করে।
4. সরকারি উদাসীনতা, শোষণ ও বঞ্চনা
নীল বিদ্রোহের কারণ হিসেবে ইংরেজ সরকারের উদাসীনতা, শোষণ ও বঞ্চনা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ অধিক মুনাফা লাভের জন্য এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিস্তারের জন্য ভারতীয় কৃষকদের উপর ইংরেজ সরকার দ্বারা যে অত্যাচার নেমে এসেছিল তার ফলশ্রুতি হিসেবে নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়ে থাকে।
5. খাদ্যশস্যের অভাব
ইংরেজ নীলকর সাহেবরা অধিক মুনাফা লাভের জন্য ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের সর্বত্র জায়গায় নীল চাষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। ফলে সাধারণ কৃষি জমিগুলি নীল চাষের জমিতে রূপান্তরিত হয় এবং কৃষিকাজ ব্যাহত হয় ও খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়। এটি নীল বিদ্রোহের কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম।
6. লর্ড বেন্টিংকের পঞ্চম আইনের প্রভাব
নীল বিদ্রোহের কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে লর্ড বেন্টিংকের পঞ্চম আইনের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ১৮৩০ সালে এই পঞ্চম আইন পাস হয়। এই আইনের বলে ইংরেজ সরকার কৃষকদের উপর জোর করে দাদন দিয়ে নীল চাষ করাতে বাধ্য হত। ফলে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় যা নীল বিদ্রোহের সূচনাকে ত্বরান্বিত করেছিল।
নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা
১৮৫৯ সালের নীল বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং নীল চাষীদের বিভিন্ন দাবিদার মেনে নেয়। তাই নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই গুরুত্ব গুলি হল নিম্নলিখিত –
1. অষ্টম আইন প্রচলন
নীল বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার অষ্টম আইন প্রচলন করেন। এই আইন অনুসারে নীল চাষ বাধ্যতামূলক নয় এটি ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৩০ সালের পঞ্চম আইনের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ ১৮৬৮ সালের অষ্টম আইনের ফলে নীল চাষ সম্পূর্ণভাবে চাষীদের ইচ্ছাধীন হিসেবে গণ্য করা হয়।
2. দাদন প্রথা প্রত্যাহার
নীল বিদ্রোহের ফলে অমানবিক দাদন প্রথা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তাই নীল বিদ্রোহ তৎকালীন কৃষক সমাজকে নতুন ভাবে বাঁচার দিশা দেখিয়েছিল।
3. নীল কমিশন গঠন
নীল বিদ্রোহের ফলে তৎকালীন ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন করতে বাধ্য হন। যা নীল বিদ্রোহের প্রাথমিকভাবে সফলতা দেয়।
4. কৃষকদের মনোবল বৃদ্ধি
নীল বিদ্রোহের ফলে কৃষকের মনোবল বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ আর পিছু হটতে বাধ্য হয়। যা নীল বিদ্রোহের বিশেষ গুরুত্বকে প্রভাবিত করে।
5. জাতীয়তাবাদের প্রসার
জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ একত্রে নীল বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যা জাতীয়বাদকে প্রসারিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক শিশির কুমার ঘোষ বলেছেন – নীল বিদ্রোহ সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিলেন।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, নীল বিদ্রোহ কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে বা একদিনের সংঘটিত হয়নি। বরং দীর্ঘদিন ধরে মুনাফা লোভী নীলকর সাহেব তথা ব্রিটিশ শাসকের অকথ্যা অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার নেপথ্যের কাহিনীর ফলস্বরূপ নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। যেটি ব্রিটিশ সরকারকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিল।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Online Sources
প্রশ্ন – নীল বিদ্রোহ
উত্তর – নীল বিদ্রোহ হল নীল চাষীদের সমন্বিত বিদ্রোহ। ১৮৫৯ সালে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। কারণ ব্রিটিশ সরকার ও নীলকর সাহেবরা অধিক মুনাফার লোভে ভারতীয় কৃষকদের জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করতে। এর ফলে কৃষকরা ধনে প্রানে মারা যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে বিদ্রোহ করে বসে। এই বিদ্রোহ ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে অধিক পরিচিত।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum
নীল বিদ্রোহের কারণ গুলি খুব সুন্দর।