হিস্ট্রির বাংলায় অর্থ ইতিহাস হলেও ঐতিহাসিকবিদগণ হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য (Difference Between History and Itihasa) বিভিন্ন দিক থেকে নির্ধারণ করে থাকেন। অর্থাৎ হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও পার্থক্য বিদ্যমান।
হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য | Difference Between History and Itihasa
হিস্ট্রি ও ইতিহাস শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ হিস্ট্রির বাংলা অর্থ হল ইতিহাস। সাধারণভাবে ইতিহাসের ইংরেজি হল হিস্ট্রি (History)। তবে ইংরেজি হিস্ট্রি শব্দটির নিছক অনুবাদ ইতিহাস নয়। ঐতিহাসিকগণ, হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করে থাকেন।
ইংরাজি হিস্ট্রি শব্দটির মতো ইতিহাস শব্দটি ও বহু প্রাচীন। এই শব্দটির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় অথর্ববেদে। তবে সুপ্রাচীনকালের ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বর্তমান কালের ইতিহাস বা ইতিহাসের সাদৃশ্য খুব বেশি নেই। কারণ প্রাচীনকালে ইতিহাস ছিল পুরাণাশ্রয়ী। এই ইতিহাস পুরাণকে অনুসরণ করেই মানব সমাজের উদ্ভব সংক্রান্ত প্রাচীন ভারতীয় ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়।
তবে যাই হোক, হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য যে সমস্ত দিক থেকে বিদ্যমান সেগুলি হল –
1. প্রথমত
মানবজাতির সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক বিবরণ কে ইতিহাস নামে অভিহিত করা হয়। গ্রিক দেশে প্রচলিত ‘ইতি-হ-আস’ থেকে ইতিহাসের উৎপত্তি। ইতিহাস শব্দটির অর্থ হল যেমনটি ঘটেছিল।
অপরদিকে হিস্ট্রি বা History শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Histor থেকে যার অর্থ হল জ্ঞান। আবার History শব্দটি গ্রিক শব্দ Historia থেকে এসেছে, যার অর্থ হল সযত্নে অনুসন্ধান করা।
2. দ্বিতীয়ত
হিস্ট্রি বলতে অতীতের বিষয়ে অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞানকে বোঝায়। গ্রিক ঐতিহাসিক এরোডোটাস এইচ টি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরেএর বহুল ব্যবহার শুরু হয়।
আর অপরদিকে ইতিহাস বলতে পুরাকাহিনীকে বোঝায়। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের ঋকবেদে বা পুরাণ ইত্যাদি কিছু ঘটনার ধারাভাষ্য থাকলেও তাদের সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ অনুপস্থিত। ইতিহাস এর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
3. তৃতীয়ত
হিস্ট্রি শুধুমাত্র ঘটনার ধারাভাষ্য বা কালানুক্রমিক পুনর্নির্মাণ নয়। হিস্ট্রির অন্তর্গত হলো কোনো ঘটনার পশ্চাত্পটে সক্রিয় কারণ বিশ্লেষণ। গ্রিসে থুকিডিডিসকে হিস্ট্রির স্রষ্টা বলা হয়। “The Pelo Polesion War” গ্রন্থে তিনি এথেন্স ও স্পার্টার নগর রাষ্ট্রগুলির সংঘাতের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে হিস্ট্রি তুলে ধরেছেন। তাই বিভিন্ন ঘটনা বিতর্কমূলক আলোচনার মাধ্যমে তিনি কার্যকারণের স্বরূপ খুঁজে পেতে সচেষ্ট হয়েছে।
আবার ভারতবর্ষের ইতিহাসের এইরকম ব্যাখ্যা করেছিলেন কৌটিল্য। মেগাস্থিনিসের লেখা ইন্ডিকা গ্রন্থে মৌর্য যুগের ব্যাখ্যা থাকলেও তা নিরপেক্ষ নয়। কিন্তু বানভট্টের রচিত হর্ষচরিত গ্রন্থে হর্ষবর্ধনের কথা থাকলেও সেখানে মধ্যভারতীয় উপজাতির সাথে কেন্দ্রীয় শক্তির সম্পর্কের বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
4. চতুর্থত
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে ইতিহাস চর্চা হতো। কিন্তু ভারতীয় ধারণা অনুসারে ইতিহাস ও হিস্ট্রি এক নয়। প্রাচীন ভারতে ধর্ম, ভাষা, পুরান এবং বিশেষত অতীতের রাজনৈতিক ঘটনাকে প্রাচীন ভারতীয়রা ইতিহাসের বিষয়বস্তু রূপে অন্তর্ভুক্ত করতেন। তাছাড়া ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যে মানুষের জীবন ও ধারাবাহিক সভ্যতার বিবরণ পাওয়া যায়নি। বরং তৎকালীন শাসক রাজাদের আলংকারিক জীবনচরিত ইতিহাস রূপে গণ্য হয়েছে।
আবার ভারতীয়দের মধ্যে হিস্ট্রি চর্চা ও রচনার নিয়ম রীতি এবং পরম্পরা ইতিহাসের ক্ষেত্রে স্থান পায়নি।
5. পঞ্চমত
হিস্ট্রির মাধ্যমে কোনো ঘটনার পরম্পরা বা সাল তারিখ অনুযায়ী তথ্যের বিবরণ ও লিপিবদ্ধকরণ ও বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ হিস্ট্রি কেবলমাত্র অতীত বিষয় কালানুক্রমিক বিবরণ নয়, বরং অতীতের আলোকে বর্তমানকে দেখা।
আর অপরদিকে প্রাচীন ভারতের প্রথম দিকের ঐতিহাসিক পরম্পরা গুলি ছিল ধর্মীয় সাহিত্যে অন্তর্নিহিত। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলেছেন – প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্য গুলো পদ্ধতিগতভাবে হিস্ট্রি পদবাচ্য না হলেও সেগুলির মধ্যে অতীত বিবরণ সংরক্ষণের গুরুত্ব, সমসাময়িক সমাজের কাছে অতীতের তাৎপর্য নিয়ে সচেতনতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যকে ঐতিহাসিক পরম্পরা বলা যায়।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে মিল থাকলেও কিছু তথ্যগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে অতীতের কোনো বিষয় বা ঘটনা সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক হোক না কেন সে সম্পর্কে আলোচনা ও চর্চার জন্য যে বিদ্যা সেটি ভারতে বাংলা ও অন্যান্য কয়েকটি ভাষায় ইতিহাস নামে পরিচিত। ইতিহাস নামক এই বিষয়টি ইংরেজি হিস্ট্রি নামক বিষয়ের সঙ্গে অভিন্ন বলেই ধরা হয়। কিন্তু প্রাচীনকালে ভারতের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা ছিল তা আধুনিককালের হিস্টির সঙ্গে অভিন্ন বা আলাদা নয়।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Difference Between History and Itihasa
- Online Sources
প্রশ্ন – হিস্ট্রি ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর – হিস্ট্রি হল কালানুক্রমিক বিশ্লেষণ। আর অপরদিকে ইতিহাস হল প্রাচীন ঘটনার বিবরণ।
প্রশ্ন – ইতিহাসের জনক কে?
উত্তর – ইতিহাসের জনক হলেন হেরোডটাস।
প্রশ্ন – ভারতীয় ইতিহাসের জনক কে?
উত্তর – মেগাস্থিনিসকে ভারতের ইতিহাসের জনক বলা হয়।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum