মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution

মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা মানবজাতির বিবর্তনের পর্যায় সমূহ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক মানব বিবর্তনের ইতিহাস (History of Human Evolution) অতি প্রাচীন এবং লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল।

মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution

সাধারণভাবে ‘এপ’ -এর থেকে মানুষের রূপান্তরের ইতিহাস পাওয়া যায়। অর্থাৎ এপ বা বনমানুষ আর মানুষের মাঝে বিরাট ব্যবধান থাকলেও কিছুটা যোগসূত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জলবায়ু ও পরিবেশগত কারণে আদিম মানুষের নানা প্রজাতির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তবে আধুনিক মানুষের রূপান্তরের প্রক্রিয়া বা আধুনিক মানব বিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ লক্ষ বছরের রূপান্তরের ফল। এ নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ পাওয়া যায়।

বিভিন্ন জীবাশ্ম বা ফসিল এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে মানব বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। এই সমস্ত তথ্য থেকে মানব বিবর্তনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। সেগুলি এখানে আলোচনা করা হল –

1. জাভা মানব

১৮৯১ থেকে ১৮৯২ সালে যা ভাই ডাচ উপনিবেশের কাছে মানুষের সদৃশ কিছু প্রাণীর কঙ্কাল খন্ড আবিষ্কৃত হয়। এগুলি ছিল মাথার খুলির উপরের অংশ, চোয়ালের হাড়, দাঁত প্রভৃতি। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় এই ফসিল গুলির ১০ লক্ষ বছর আগের বরফের যুগের।

আবার অনেক বিজ্ঞানী অনুমান করেন এই প্রজাতিটি আনুমানিক ৭ লক্ষ বছরের পুরনো। এই ফসিলের উচ্চতা ছিল সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো। এই জাভা মানবকে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের মাঝের পর্যায়ে বলে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিতকরণ করেন।

2. পিকিং মানব

মানব বিবর্তনে ইতিহাসে পিকিং মানব একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীনের পিকিং -এর আদিম মানুষের কিছু কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। জাভা মানুষের মতো এদের কিছুটা বৈশিষ্ট্যের মত মিল পাওয়া যায়। এদের নাম দেওয়া হয়েছে সিনানথ্রোপাস বা পিকিং মানব। মার্কিন জীবাশ্ম বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রুজ পিকিং মানবকে জাভা মানবের সমসাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন। তবে জাভা মানুষের মত পিকিং মানুষেরাও আগুনের ব্যবহার জানতো না কিন্তু হার ও পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল।

3. নিয়ানডার্থাল

বরফযুগের মধ্যে এবং শেষ ভাগে ইউরোপীয় মানুষের কিছু দেহাবশেষ বা কঙ্কাল আবিষ্কার হয়। জার্মানির নিয়ানডার্থাল অঞ্চলে প্রথমে এই কিসের সন্ধান পাওয়া যায়। এই জন্য এদের নামকরণ করা হয় নিয়ানডার্থাল মানব। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে এই ধরনের মানুষের অস্তিত্ব ছিল। এছাড়া ফ্রান্স, প্যালেস্টাইন, পূর্ব আফ্রিকা এবং রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ানডার্থাল মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এই ধরনের মানুষেরা দৈহিক দিক থেকে বেঁটেখাটো ছিল এবং শক্তিশালী ছিল। এদের উচ্চতা ছিল সাড়ে পাঁচ ফুট এবং মস্তিষ্ক ছিল আধুনিক মানুষের মতো বড়।

নিয়ানডার্থাল যুগের মানুষেরা আগুন এর ব্যবহার জানতো। এই যুগের মানুষেরা মৃতদেহকে কবর দিত কবরের সঙ্গে মৃতের ব্যবহৃত জিনিস সামগ্রী দিয়ে দিত। অর্থাৎ তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পেরেছিল। নিয়ানডার্থাল ছিল আনুমানিক ৪ লক্ষ বছর আগের মানব প্রজাতি এবং তারা ইউরোপের দীর্ঘদিন নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

4. রোডেশীয় মানব

নিয়ানডার্থাল এবং আধুনিক মানুষের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের মানব প্রজাতি হলো রোডেশীয় মানব। ১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের ক্রোমেনিয়ান অঞ্চলে এই একই প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া গেছে । পরবর্তীকালে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার রোডেশীয়ার এই মানব প্রজাতির দেয়া বোশেষ পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন এই মানব প্রজাতি খোঁজা হয়ে হাঁটতে পারতো এবং এদের দাঁত ও হাড়ের গঠন ছিল আধুনিক মানুষের মতো। তাই রোডেশীয় মানবকে আধুনিক মানবের নিকট আত্মীয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এই রোডেশীয় মানবপ্রজাতি আনুমানিক তিন লক্ষ থেকে দু লক্ষ বছর পর্যন্ত প্রাচীন প্রকৃতির হিসেবে গণ্য হয়েছে।

5. হাইডেলবার্গ মানব

হাইডেলবার্গ মানব প্রজাতি ১৯০৭ সালে পশ্চিম ইউরোপের জার্মানির হাইডেলবার্গ এর কাছে আবিষ্কৃত হয়। এই মানব প্রজাতি আধুনিক মানুষের কাছাকাছি এবং মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত। বিজ্ঞানীদের অনুমান প্রায় 6 লক্ষ থেকে তিন লক্ষ বছর আগে এই মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল। এদের দাঁতের ধরন আধুনিক মানুষের মত ছিল।

6. হোমো হাবিলিস

হোমো হাবিলিস মানব প্রজাতি আধুনিক মানব হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ এই মানবপ্রজাতি আনুমানিক 25 লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। হোমো হাবিলিস কথার অর্থ হল দক্ষ মানুষ। এই মানব প্রজাতি দলগতভাবে থাকতো এবং হাঁটতে পারতো। তবে এরা কাঁচা মাংস খেত এবং পাথরের হাতিয়ার বানানোর কৌশল ব্যবহার করতে জানতো। ১৯৬০ সালে লিখি দম্পতি হোমো হাবিলিসদের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন। এদের দাঁত এবং পায়ের অস্থির গঠনে আধুনিক মানুষের সঙ্গে বেশ মিল আছে।

উপসংহার

সর্বোপরি বলা যায়, মানব বিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিবেশ পরিবর্তনের ও বিবর্তনের ফলে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে এবং আধুনিক মানুষে এসে উপনীত হয়েছে। তাই মানবজাতির বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যায়। কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম বা ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে মানব প্রজাতির ইতিহাস জানার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • Online Sources

প্রশ্ন – প্রথম আদিম মানুষের নাম কি?

উত্তর – বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী প্রথম আদিম মানুষের নাম হল আদম। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম আদিম মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যেটির নাম হল Lucy (১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত একটি জীবাশ্ম, যার বয়স প্রায় ৩.২ মিলিয়ন বছর)। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম আদিম মানুষের কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই।

প্রশ্ন – মানুষের উৎপত্তি কোথা থেকে?

উত্তর – মানুষের উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ফসিল প্রমাণ অনুযায়ী, আজ থেকে আনুমানিক দুই লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের (Homo sapiens) উৎপত্তি হয় ।

প্রশ্ন – মানবজাতির বিবর্তন কাকে বলে?

উত্তর – মানবজাতির বিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান মানুষে পরিণত হওয়াকে মানবজাতির বিবর্তন বলে। অর্থাৎ বর্তমানে যে আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় তা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তনের ফলে সম্ভব হয়েছে।

প্রশ্ন – হোমো স্যাপিয়েন্স কথার অর্থ কি?

উত্তর – “Homo sapiens” একটি লাতিন শব্দ যেটি Homo যার অর্থ মানুষ এবং Sapiens যার অর্থ জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান। অর্থাৎ, “Homo sapiens” -এর অর্থ হল ‘বুদ্ধিমান মানুষ’ বা ‘জ্ঞানী মানুষ’

প্রশ্ন – আদিম মানুষের উৎপত্তি কোথায় হয়েছিল?

উত্তর – বিজ্ঞানীদের অনুমান আদিম মানুষের উৎপত্তি পূর্ব আফ্রিকার পূর্বাংশ হয়েছিল। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাচীনতম মানবজাতির ফসিল অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

আরোও পোস্ট পড়ুন

মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

close