রোমান সাম্রাজ্য পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিস্তৃত সাম্রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এর সংস্কৃতি, আইনব্যবস্থা এবং সামরিক শক্তি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কিন্তু কালের নিয়মে এই বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের পতন (Fall of the Roman Empire) ঘটে।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | Reasons for the Fall of the Roman Empire
রোম সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর বিস্ময়কর সাম্রাজ্য। এর বিস্তৃত ছিল ইউরোপ ও আফ্রিকা ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশ পর্যন্ত। এই সুবিশাল সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও কালের নিয়মে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তবে রোমান সাম্রাজ্য দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা – পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যেটি ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পতন ঘটে এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য যেটি ১৪৫৩ সালে পতন ঘটে। এরপর রোমান্স সভ্যতার চূড়ান্ত অবসান ঘটে। তবে অনেক ঐতিহাসিক পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনকে রোমের পতন হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ (Reasons for the Fall of the Roman Empire) হিসেবে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলি পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
বর্বর উপজাতিদের আক্রমণ
রোমান সাম্রাজ্য পতনের কারণ হিসেবে বর্বর উপজাতিদের আক্রমণকে অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। 300 খ্রিস্টাব্দের থেকে রোমান বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে বর্বর উপজাতিদের আক্রমণ বাড়তে থাকে। এই সময় গথ নামক বর্বর উপজাতি রোমান সাম্রাজ্যকে বারবার আক্রমণ করেন।
আবার 460 সালে ভিসিগথ রাজা অ্যালারিক রোম সাম্রাজ্য দখল করেন। পরবর্তীকালে ৪৭৬ সালে জার্মান নেতা ওডেসার রোমান সম্রাট রমুলাস অগাস্টাসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ফলে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয় বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয়
রোমান সাম্রাজ্যে বিশাল সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল অর্থ প্রয়োজন হতো। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা ও শোষণজনিত কারণে এই ব্যয়ভার সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় করার জন্য রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ধংসের মধ্যে এগিয়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি
রোমের পরবর্তী যুগে সম্রাটদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি কমে আসে। অনেক শাসক অযোগ্য, লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার লড়াই এতটাই বেড়ে যায় যে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস হতে থাকে। এতে জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
সামরিক দুর্বলতা
প্রাথমিক যুগে রোমের সেনারা ছিল দেশপ্রেমিক ও প্রশিক্ষিত। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা ভাড়াটে সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যারা ছিল অনুগত নয় ও প্রায়শই বিশ্বাসঘাতক। এর ফলে সীমান্ত রক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাইরের জাতির আক্রমণে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। তাই সামরিক দুর্বলতা ও নতুন প্রযুক্তির অভাব রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বৃহৎ সেনাবাহিনী
রোমান সাম্রাজ্যের বিশাল সীমানা রক্ষা করার জন্য বিশাল সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল। কিন্তু আদতে এই বৃহৎ আকার সেনাবাহিনী পরিচালনার অভাব নোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। তাছাড়া সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য অর্থসংকটের ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী ও প্রযুক্তিগত অগ্রসর সেরকম ঘটেনি।
অর্থনৈতিক সংকট
বহিঃশত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে রোমের সম্রাটগণ সামরিক ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি করেন। যার প্রভাব পড়ে সাম্রাজ্যের অর্থনীতির উপর। আবার ক্রীতদাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে কৃষি কাজে উৎপাদন কমে যায়।
তাছাড়া কর ব্যবস্থার বৈষম্যের জন্য রোমে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়তে থাকে। কৃষিক্ষেত্রেও উৎপাদন কমে যায়। অধিক কর আদায়ের ফলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। সেই সাথে মুদ্রার পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে মুদ্রার মান কমে যায়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যব্যাপী বাণিজ্য ভেঙে পড়ে। এভাবে রোমান অর্থনীতিতে চূড়ান্ত অবনমন দেখা দেয়।
সামাজিক অবক্ষয়
রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের আগে নৈতিকতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ কমে যায়। মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে ডুবে যেতে থাকে। দেশ ও সমাজের কল্যাণের চেয়ে ভোগ-বিলাসকে অগ্রাধিকার দেয়। এই মানসিক অবক্ষয় সমাজকে ভিতর থেকে দুর্বল করে তোলে এবং পতনের পথ সহজ করে দেয়।
দক্ষ শ্রমিকের অভাব
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিকের অভাব। কারণ সাম্রাজ্যের অর্থনীতি অনেকাংশেই ক্রীতদাসদের শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যের প্রসারণ থেমে যায় এবং ক্রীতদাসদের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক ও কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে, যা রোমান সাম্রাজ্যের পতনকে (Fall of the Roman Empire) অনিবার্য করে তুলেছিল।
Reasons for the Fall of the Roman Empire
প্রাকৃতিক অবক্ষয়
দ্বিতীয় শতক থেকে রোমান সাম্রাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়। এর ফলে আদায় কৃত রাজস্বের পরিমাণ কমে যায় ও অর্থনীতিতে দুর্যোগ নেমে আসে। ফলে রোমান সাম্রাজ্য সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া খরা ও মহামারীতে বহু লোকের মৃত্যুর ফলে এক সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রোমান সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
পূর্ব সাম্রাজ্যের উত্থান
তৃতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যকে পূর্ব ও পশ্চিম এই দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে এই রকমের বিভাজন করা হয়। প্রথমদিকে বিভাজনের উদ্দেশ্য সফল হলেও পরবর্তীকালে এই দুটি রাজ্যের মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। আবার বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে এই দুটি অংশ ব্যর্থ হয়। ফলে সম্পদ ও সেনাবাহিনী নিয়ে প্রায় সময় তাদের মধ্যে গন্ডগোল বেধে যেত।
সামাজিক বৈষম্য ও ক্রীতদাস প্রথা
রোমান সাম্রাজ্যের সামাজিক বৈষম্য -এর পাশাপাশি দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা ক্রীতদাসদের উপর অকট্য অত্যাচার চালাতো। পরবর্তীকালে ক্রীতদাসদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেলেও সাধারণ জনগণ ও ক্রীতদাস শ্রেণীর মানুষেরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে ধীরে ধীরে হয়ে যাওয়া রোমান সাম্রাজ্য কে টিকিয়ে রাখার কোন আগ্রহই তৃতীয় শ্রেণীর জনগণ বা ক্রীতদাস দেখায়নি।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, বিশাল রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। মহামারী থেকে শুরু করে, বর্বরদের আক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকট, দক্ষ সেনাবাহিনীর অভাব, রোমার নাগরিকদের নৈতিক অবনয়ন, ক্রীতদাস প্রথা, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি রোমান সাম্রাজ্যকে ধীরে ধীরে পতনের ( Fall of the Roman Empire) দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন বলেছেন – পঞ্চম শতকে বর্বরদের আক্রমণের ফলে রোমানের পতন ঘটেনি বরং এর চূড়ান্ত অবক্ষয় সচেতন হয়েছিল ইসলামের উত্থান ও প্রসারের ফলে। আবার তিনি মনে করেন – ইউরোপে ইসলামের অনুপ্রবেশের ফলে এবং ভূমধ্যসাগরের উপর আরবদের আধিপত্য বিস্তারের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। এর ফলে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং যার পরিণতি হিসেবে এখানে সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Reasons for the Fall of the Roman Empire
- Online Sources
প্রশ্ন – রোমান সাম্রাজ্যের পতন কবে হয়
উত্তর – রোমান সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কারণ রোমান সাম্রাজ্য দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা – পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে 1453 খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন – রোমান সভ্যতার পতনের কারণগুলো কী কী ছিল?
উত্তর – বিশাল রোমান সভ্যতার পতনের কারণ গুলো বিভিন্ন প্রকারের ছিল। সেগুলি হল – বর্বর উপজাতিদের আক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকট, উপযুক্ত সেনাবাহিনীর অভাব, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিক অবনয়ন, সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, সামাজিক বৈষম্য, ক্রীতদাসদের আন্দোলন প্রভৃতি।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | 10 Reasons for the Fall of the Roman Empire
- প্রাচীন রোমের দাস ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা | Slavery in Ancient Rome
- মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution
- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রশ্ন উত্তর | Fort William College Quiz Question and Answers
- বাংলা গদ্য সাহিত্যে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান | Contribution of Serampore Mission to Bengali Prose
- বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | 10 Reasons for the Fall of the Roman Empire সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।