আধুনিক ভারতের জনক ও নবজাগরণের অন্যতম পথপ্রদর্শক রাজা রামমোহন রায়। তৎকালীন কুসংস্কার যুক্ত অন্ধকারের নিমজ্জিত সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান (Raja Ram Mohan Roy Social Reformer) ছিল এক কথায় প্রশংসনীয়।
ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায় 1774 সালে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে পিতার সঙ্গে মনোমালিন্য হয় এবং এই কারণে তিনি গৃহত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে তিনি ভ্রমণ করেন এবং সংস্কৃত, পারসি, আরবি প্রভৃতি ভাষায় তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। 1803 সালে পিতার মৃত্যু হলে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। 1804 সালে রামমোহন রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন এবং 1814 সালে এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সামাজিক সংস্কারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে।
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy Social Reformer
রাজা রামমোহন রায়ের সময় কালে সমাজ ব্যবস্থা ছিল অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারে নিমজ্জিত। ঘুনধরা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান গুলি হল নিম্ন লিখিত –
1. সতীদাহ প্রথা রদ
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান হল সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত অমানবিক ও নিষ্ঠুর সতিদাহ প্রথা প্রচলন ছিল। যা সমাজে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল। রাজা রামমোহন রায় এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
রামমোহন অনুভব করেছিলেন যে, শাস্ত্রবাক্য দ্বারা সতীদাহের প্রতিবাদ না করলে সমাজের ব্যক্তিগণ তা গ্রাহ্য করবে না। তাই তিনি শাস্ত্রকে ভিত্তি করে বিভিন্ন পুস্তক পুস্তিকা রচনা করেন। তাছাড়া তিনি 300 ব্যক্তির স্বাক্ষর নিয়ে সরকারকে সতীদাহ নিষিদ্ধ করার জন্যে অনুরোধ জানান।
তাঁর আক্রান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতায় 1829 সালে 17 নভেম্বর লর্ড বেন্টিংক সতিদাহ প্রথা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রাচীন অমানবিক সতীদাহ প্রথা অবসান ঘটান।
2. ধর্মীয় সংস্কার
রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তিনি হিন্দু সমাজের মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার চেয়ে তাঁর কাছে নিরাকার ব্রম্ভের উপাসনা অনেক বেশি ভালো বলে মনে হয়েছিল। আর এই উপলব্ধির ফলে তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
3. নারীর অধিকার রক্ষা
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান হল নারীর অধিকার রক্ষা করা। অর্থাৎ নারীর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় আজীবন লড়াই করে গেছেন। তিনি মনে করতেন সমাজে নারীরা অসহায় এবং বিভিন্ন দিক থেকে লাঞ্ছিত বঞ্চিত হয়। তাই রাজা রামমোহন রায় নারীদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
তাছাড়া রাজা রামমোহন রায় নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে লড়াই করেছিলেন। সেই সময় সমাজ ব্যবস্থা সম্পত্তির উপর নারীদের অধিকার ছিল না। তাই পিতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর বা অন্য কোনো কারণে নারীদেরকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এর বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় প্রতিবাদ করেছিলেন।
তিনি মনে করতেন উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব। তাই তিনি নারী শিক্ষার বিস্তার সাধনের কথা বলেছিলেন।
4. নারীর ক্ষমতায়ন
রাজা রামমোহন রায় নারী শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে সচেষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ নারী শিক্ষার বিস্তার বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে নারী শিক্ষা প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই নারী শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং অন্যদেরকেও নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
5. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা
রাজা রামমোহন রায় বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা করতেন। তিনি বলেন অন্য কোন কারণ ব্যতীত পুরুষকে বারবার বিবাহ করা বা বহুবিবাহ করা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ। তাছাড়া তিনি তৎকালীন সমাজের বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন।
6. আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান হল আত্মীয় সভার প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ রামমোহন ধর্ম সম্বন্ধীয় মতামত সম্পর্কে আলোচনার জন্য কলকাতায় তাঁর বন্ধুদের নিয়ে 1815 সালে ‘আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই আত্মীয়সভার সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ। এই আত্মীয়সভার উদ্দেশ্য ছিল – হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি ও কুপ্রথা দূর করার উপায় অনুসন্ধান করা।
7. ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা
1828 সালে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন। 1830 সালে এই ‘ব্রাহ্মসভার’ নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম সমাজ রাখা হয়। রাজা রামমোহনের ব্রাহ্ম সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল – তৎকালীন সমাজের সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বধর্মের সমন্বয় ঘটানো এবং একেশ্বরবাদ প্রচার করা।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, রাজা রামমোহন রায় ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম যুগপুরুষ। যিনি প্রাচীন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন।
তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে যথার্থ বলেছিলেন – ” তিনি কি না করেছিলেন? শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, ধর্ম বল, সমাজ বল, বঙ্গসমাজের যে কোন বিভাগ উত্তরোত্তর যতই উন্নত হইতেছে, সে কে বল তাঁহারই হস্তাক্ষর নতুন নতুন পৃষ্ঠায় উত্তরোত্তর পরিস্ফুটতর হইয়া উঠিতেছে মাত্র।” তাই সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান (Raja Ram Mohan Roy Social Reformer) আধুনিক যুগেও অস্বীকার করা যায় না।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Online Sources
প্রশ্ন – রামমোহন রায় রচিত দুটি গ্রন্থের নাম
উত্তর – রামমোহন রায় রচিত দুটি গ্রন্থের নাম হল – গৌড়ীয় ব্যাকরণ এবং ব্রাহ্ম সংগীত। তাছাড়া কুসংস্কারের প্রতিবাদে লেখা বিভিন্ন রচনা তাকে তৎকালীন সমাজে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় কে ভারত পথিক বলে কে নামকরণ করেছিলেন?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় কে ভারত পথিক বলে কে নামকরণ করেছিলেন বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় কে ভারতীয় রেনেসাঁর জনক উপাধি দেন কে?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় কে ভারতীয় রেনেসাঁর জনক বা ‘আধুনিক ভারতের জনক’ উপাধি দেন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে।
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় এর রাজা উপাধি কে দেন?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় এর রাজা উপাধি দেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum