সারা পৃথিবীর মত ভারতের লেখ্যাগারের ইতিহাস পাওয়া যায়। অর্থাৎ ভারতের লেখ্যাগারের ইতিহাস (History of Indian Archives) অতি প্রাচীন এবং এর পরিসর অনেকটা বিস্তৃত প্রকৃতির। তাই সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে লেখ্যাগারে নথি সংরক্ষণের ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
ভারতের লেখ্যাগারের ইতিহাস | History of Indian Archives
ভারতীয় সভ্যতা হল পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস সারা বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা পায়। তাই ভারতের লেখ্যাগারের ইতিহাস বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় বহিরাগতদের আক্রমণ ও বিদেশী শক্তির প্রভাবের ফলে অনেক বহু মূল্যবান বস্তু নষ্ট হয়ে গেছে ও লুট হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের লেখ্যাগারে এখনো পর্যন্ত যত সমস্ত নথি সংরক্ষিত রয়েছে তা ভারতের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পক্ষে যথেষ্ট।
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ভারতের লেখ্যাগারের ইতিহাসকে কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনা করা যায়, তা হল –
প্রাচীন বৈদিক যুগ বা ব্রাহ্মণ্য যুগ
প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণ যুগে মুখে মুখে শিক্ষাদান দেওয়ার রীতি প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। যা তৎকালীন সময়ের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভিন্ন দিকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে। অর্থাৎ প্রাচীনকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক যেগুলো রচিত হয়েছিল পরবর্তীকালে সেগুলোকে সংরক্ষণ ও সঞ্চালন করা হয়ে থাকে। যেমন বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন অমূল্য সাহিত্য ভান্ডার বা সাহিত্য সৃষ্টি।
বৌদ্ধ যুগ
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ যুগে লেখ্যাগারের বা মহাফেজখানার সন্ধান পাওয়া যায়। তৃতীয় এবং সপ্তম শতাব্দীতে যে সমস্ত চিনা পর্যটক ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাদের লেখায় ও বিবরণীতে মহাফেজখানার সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া বৌদ্ধ যুগে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার গুলিতে নথি সংরক্ষণ করে রাখা হতো। যদিও ভারতবর্ষের বিভিন্ন বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে অনেক বৌদ্ধ বিহার (যেমন – নালন্দা ও তক্ষশীলা) ও তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ বহু নথি ধ্বংস হয়ে যায়।
ইসলামিক যুগ
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকালে লেখ্যাগারের বা মহাফেজখানার ইতিহাস পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকালে ইউরোপিয়ান ও আরবীয় পর্যটকদের লিখিত নথি ও রাজ্য বিস্তার সংক্রান্ত বিভিন্ন ইতিহাস ও নথি মজুদ করার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।
মুঘল আমলে জমির নথি সংরক্ষিত রাখার জন্য ‘খাঞ্জাঞ্জি রাজ’ ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছিল। আবার বিভিন্ন মোগল শাসকেরা খাজনা আদায় বা কর আদায়, জমির বিভিন্ন তথ্য, রাজকার্য পরিচালনা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নথি আকারে সঞ্চিত করতেন। আকবর নামাতে সম্রাট তার দরবারে বিভিন্ন নির্দেশিকা লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত করার জন্য ১৫৭৪ সালে দপ্তর খানা প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্রিটিশ ও আধুনিক যুগ
ভারতবর্ষে লেখ্যাগারের বা মহাফেজখানার বিস্তার লাভ করে ব্রিটিশ যুগে। অর্থাৎ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকালে আধুনিক লেখ্যাগারের ধারণাটির জন্ম ঘটে। ব্রিটিশ শাসনকালে নথি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও যা উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক বহু নথি নষ্ট হয়ে যায়। এ পর্যন্ত ব্রিটিশ যুগের সবথেকে পুরনো নথি হল ১৬৩০ সালে ২৬ শে জুলাই এর একটি কাগজ। যেটি মহারাষ্ট্রের স্টেট আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে।
পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে তাদের দপ্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি গুলি সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সেগুলি সংরক্ষণের কথা ভাবা হয়। ব্রিটিশ যুগে নথি সংরক্ষণের জন্য যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখ্যাগার তৈরি হয়েছিল সেগুলি হল –
i) জমি সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণ করার জন্য ১৮২০ সালে বাংলায় প্রেসিডেন্সি কমিটি অফ রেকর্ডস এবং আঞ্চলিক মুফসিল কমিটি তৈরি হয়।
ii) ১৮২১ সালে বাংলা সরকার ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলার জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র সংরক্ষিত রাখার জন্য বোম্বে রেকর্ডস অফিস তৈরি হয়।
iii) ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত নথি সংরক্ষণের জন্য কলকাতায় ইম্পিরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট তৈরি করেন। জি ডব্লু ফরেস্ট এই কেন্দ্রীয় লেখ্যাগারের প্রথম পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী পরিবর্তনের সময় এটি দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।
iv) ১৯২৬ সালের দিল্লিতে লেখ্যাগারের লাল পাথরের নতুন ভবনের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৯৩৭ সালের মধ্যে কলকাতা থেকে সমস্ত নথি দিল্লির লেখ্যাগারে স্থানান্তরিত হয়।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের তৈরি বিভিন্ন লেখ্যাগার থাকলেও স্বাধীনতার পর সরকারি বিভিন্ন নথি রাখার সমস্যা দেখা দেয়। ফলে স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে বিভিন্ন জায়গায় লেখ্যাগার তৈরি করা হয়। তাছাড়া আলাদা করে স্বাধীনতার পর নথি সংরক্ষণের উপর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যদিও ভারতীয় ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নথি গুলি ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়াতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
তবে 1975 সালের মধ্যে অন্ধপ্রদেশ, উড়িষ্যা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি রাজ্য তাদের নিজস্ব উদ্যোগে রাজ্য লেখ্যাগার গড়ে তোলে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
i) ১৯৫৬ সালে মধ্যপ্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় মধ্যপ্রদেশের আর্কাইভ
ii) ১৯৬৪ সালে পুণেতে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া।
iii) ১৯৮৯ সালে শিমলায় প্রতিষ্ঠিত হয় হিমাচল প্রদেশ স্টেট আর্কাইভ।
iv) ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্ণাটক স্টেট আর্কাইভ।
v) ২০০৩ সালে নিউ দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল মিশন ফর ম্যানুস্ক্রিপ্ট।
vi) ২০১২ সালে কোহিমাতে প্রতিষ্ঠিত হয় নাগাল্যান্ড স্টেট আর্কাইভ।
এগুলি ছাড়াও আসাম স্টেট আর্কাইভ, বিহার স্টেট আর্কাইভ, হরিয়ানা স্টেট আর্কাইভ, উড়িষা স্টেট আর্কাইভ, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আর্কাইভ, সিকিম স্টেট আর্কাইভ, পাঞ্জাব স্টেট আর্কাইভ, রাজস্থান স্টেট আর্কাইভ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- History of Indian Archives
- Online Sources
প্রশ্ন – সরকারি নথিপত্র কোথায় জমা থাকে?
উত্তর – সরকারি নথিপত্র ডিজিটাল আর্কাইভ বা লেখ্যাগারে মহাফেজখানার মধ্যে জমা থাকে।
প্রশ্ন – সরকারি নথিপত্র রাখার স্থান কোনটি?
উত্তর – সরকারি নথিপত্র রাখার স্থান হল আর্কাইভ বা লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা।
প্রশ্ন – ভারতের জাতীয় মহাফেজ খানা কোথায় অবস্থিত?
উত্তর – ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা হল ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া। এটি ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় জাতীয় মহাফেজখানা নিয়ে বর্তমানে নিউ দিল্লিতে অবস্থিত।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- মানব বিবর্তনের ইতিহাস বা পর্যায় সমূহ | History of Human Evolution
- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রশ্ন উত্তর | Fort William College Quiz Question and Answers
- বাংলা গদ্য সাহিত্যে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান | Contribution of Serampore Mission to Bengali Prose
- বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose
- বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা | Vidyasagar Contribution to Bengali Literature
- বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature