বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকালে প্রধানত ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা অগ্রসর হন। এর ফলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (Contribution of Fort William College) প্রতিষ্ঠিত হয় যেটি বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছিল।

বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose

ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের শাসন কায়েম রাখার জন্য শিক্ষার বিস্তারে মনোযোগ দেন। এই শিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিলের থেকে আসা তরুণ সিভিলিয়নদের দেশীয় শিক্ষায় বা ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা। যাতে ইংরেজিতে রাজত্ব বিস্তার সহজ হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৮০০ সালের মে মাসে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে কলকাতার লালবাজারে “The College of Fort William” গঠিত হয়. যেটি পরবর্তীকালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নামে খ্যাতি লাভ করে।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব পান উইলিয়াম কেরী। পরবর্তীকালে আরো বিশিষ্ট ব্যক্তি সমূহের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কারণ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কৃতি শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা তথা বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকশিত লাভ করে।

বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান বা বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবদান উল্লেখ করা হলো।

1. উইলিয়াম কেরী

১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরী ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব পান। তখন তিনি উপলব্ধি করেন বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক নেই। অর্থাৎ কিছু পদ্যের বই থাকলেও বাংলা গদ্য পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাই উইলিয়াম কেরী নিজে কিছু পুস্তক রচনা করতে উদ্যোগী হন। বাংলা গদ্য সাহিত্যে উইলিয়াম কেরী রচিত অন্যতম গ্রন্থ গুলি হল –

i) কথোপকথন (১৮০১ সাল),

ii) ইতিহাসমালা (১৮১২ সাল),

2. রামরাম বসু

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম কৃতিত্ব স্থানীয় বাংলা ভাষায় পারদর্শী শিক্ষক ছিলেন রামরাম বসু। এই রামরাম বসু উইলিয়াম কেরীকে বাংলা শেখাতেন। সে জন্য তাকে কেরী সাহেবের মুন্সি বলা হত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর রামরাম বসু বাংলার শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। কেরী সাহেবের অনুরোধে তিনি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। অর্থাৎ বাংলা গদ্য সাহিত্যে রামরাম বসুর অবদান ছিল অসামান্য। রামরাম বসু রচিত অন্যতম গ্রন্থ গুলি হল –

i) রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১ সাল),

ii) লিপিমালা (১৮০২ সাল),

3. চণ্ডীচরণ মুন্সি

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন চণ্ডীচরণ মুন্সী। বাংলা গদ্য সাহিত্যে চণ্ডীচরণ মুন্সির অবদান ছিল অসামান্য। অর্থাৎ বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান হিসেবে চণ্ডীচরণ মুন্সী গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ গুলি হল –

i) তোতা ইতিহাস (১৮০৫ সাল)। এই গ্রন্থটি তুতিনামা ফার্সি গ্রন্থের অনুবাদ।

4. মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অন্যতম জ্ঞানী মানুষ। অর্থাৎ জ্ঞানে বিদ্যায় তিনি ছিলেন অনন্য ও অদ্বিতীয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকতা করাকালীন তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ বা বাংলা গদ্য সাহিত্যের জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

i) বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২ সাল),

ii) হিতোপদেশ (১৮০৮ সাল),

iii) রাজাবলি (১৮০৮ সাল),

iv) প্রবোধচন্দ্রিকা। এই গ্রন্থটি রচিত হয় ১৮১৩ সালে এবং মুদ্রিত হয় ১৮৩৩ সালে।

5. কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন

বাংলা গদ্য সাহিত্যে কাশিনাথ তর্ক পঞ্চাননের রচিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ গুলি হল –

i) পদার্থ তত্ত্বকৌমুদি (১৮২১ সাল),

ii) আত্মতত্ত্বকৌমুদি (১৮২২ সাল)।

এগুলি ছাড়াও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিত মুন্সীদের দ্বারা রচিত আরো অন্যান্য পুস্তক যেগুলি বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল, এগুলি হল –

i) গোলকনাথ শর্মা – হিতোপদেশ (১৮০২ সাল)

ii) রাজিবলোচন মুখোপাধ্যায় – মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫ সাল)

iii) রামকিশোর তর্কচূড়ামণি – হিতোপদেশ (১৮০৮ সাল)

iv) তারিনীচরণ মিত্র – ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট (১৮০৩ সাল)। এই গ্রন্থটি ঈশপ্স ফেবলস -এর অনুবাদ।

v) হরপ্রসাদ রায় – পুরুষ পরীক্ষা (১৮১৫ সাল)

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কৃতি শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকগণের দ্বারা বাংলা গদ্য সাহিত্যের পথ চলা শুরু হয়েছিল। যা বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল।

উইলিয়াম কেরী থেকে শুরু করে রামরাম বসু, গোলকনাথ শর্মা, তারিনী চরণ মিত্র, চণ্ডীচরণ মুন্সি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, কাশীনাথ তর্ক পঞ্চানন প্রমূখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা তৎকালীন বাংলা গদ্য সাহিত্য পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। তবে পরবর্তীকাল রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাহিত্যিক বাংলা গদ্য সাহিত্য ভান্ডারকে রত্ন খচিত করে তুলেছিল।

তথ্যসূত্র | Sources

  • বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৩-৫ খন্ড)- সুকুমার সেন
  • বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস- সজনীকান্ত দাস
  • বাংলা সাহিত্যে গদ্য- সুকুমার সেন
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (৬-৯)- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (৩-৪)- ভূদেব চৌধুরী
  • আধুনিক বাংলা কাব্য- তারাপদ মুখোপাধ্যায়
  • উনিশ শতকের গীতিকাব্য- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • বাংলা সাময়িক পত্র- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • আমার কালের কয়েকজন কবি- জগদীশ ভট্টাচার্য
  • রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
  • Internet sources
  • Contribution of Fort William College Bengali Prose

প্রশ্ন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কে কবে প্রতিষ্ঠা করেন

উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কলকাতা লালবাজারের একটি অঞ্চলে ১৮০০ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রশ্ন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দুজন শিক্ষকের নাম কি?

উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দুজন শিক্ষকের নাম হল উইলিয়াম কেরী এবং রামরাম বসু।

প্রশ্ন – রামরাম বসুর লেখা গ্রন্থের নাম কি?

উত্তর – রামরাম বসুর লেখা গ্রন্থের নাম হল রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১ সাল) এবং লিপিমালা (১৮০২ সাল)।

প্রশ্ন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়

উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে বাংলা ভাষায় প্রায় ৫৪ টার বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তাই বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান ছিল অন্যতম।

প্রশ্ন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কে প্রতিষ্ঠা করে

উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রশ্ন – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ কে ছিলেন

উত্তর – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ (প্রথম) ছিলেন ডঃ জন গিলক্রিস্ট (Dr. John Borthwick Gilchrist)।

আরোও পোস্ট পড়ুন

বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান | Contribution of Fort William College Bengali Prose সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

close