শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা ও সংস্কার | Administrative Reforms of Sher Shah Suri

ভারতবর্ষের ইতিহাসে দিল্লির অন্যতম শাসক ছিলেন শের শাহ। তাঁর রাজত্বকালে শাসন ব্যবস্থা ও সংস্কার (Administrative Reforms of Sher Shah Suri) ছিল মৌলিক ও প্রতিভা সম্পন্ন।

শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা | Administrative Reforms of Sher Shah Suri

আনুমানিক ১৫৪০ সালে দিল্লি সিংহাসন দখল করে শেরশাহ উপাধি নিয়ে সুরি বা শূর বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। সিংহাসন লাভের পর অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, সুলতান, মালব, গোয়ালিয়র প্রভৃতি রাজ্য জয় করেন ও আধিপত্য বিস্তার করেন। পরবর্তীকালে বুন্দেলখন্ডের কালীঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করতে গেলে এক বিস্ফোরণে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যু হয়।

Administrative Reforms of Sher Shah Suri Image

শেরশাহ ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর রাজত্বকালে তারা সামান্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। তার শাসনব্যবস্থা ও সংস্কারের বিভিন্ন দিক এখানে আলোচনা করা হলো।

1. কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম ছিল কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা। এই শাসন পদ্ধতির উৎস ছিল তুর্কি সুলতানদের আমলে প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা ও পারসিক শাসন পদ্ধতি। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল সুলতান বা শেরশাহের নিজের। কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনার জন্য সম্রাট চার জন মন্ত্রী নিয়োগ করেন। এরা হলেন – রাজস্ব বা অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাজকীয় ইস্পাহার তৈরি ও প্রেরণের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

2. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি শেরশাহের রাজত্বকালে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য শেরশাহ সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি সরকারের ও প্রতিটি সরকারকে কয়েকটি পরগনা বিভক্ত করেন। এই পরগণনাগুলি ছিল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। তাছাড়া গ্রামের শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শেরশাহ দেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।

3. রাজস্ব ব্যবস্থা

রাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শেরশাহের অভিনব চিন্তা ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ শেরশাহ রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেন। কৃষি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

i) জমির পরিমাণ যথাযথ মাপজোকের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ,

ii) রাষ্ট্রের প্রাপ্ত ফসলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা,

iii) কৃষকদের জমির পরিমাণ ও সত্য নির্দিষ্ট করা এবং

iv) মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিকার বিলুপ্ত করা ও ভূমি রাজস্ব যথাসম্ভব নগদ অর্থে আদায় করা প্রভৃতি।

শেরশাহ সর্বপ্রথম জমি জরিপের ব্যবস্থা করেন। তার শাসনকালে উৎপাদন শক্তি অনুসারে জমিগুলোকে ভালো, মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। জমিতে উৎপন্ন ফসলের একের 3 অংশ বা একের চার অংশ রাজস্ব দিতে হতো। তিনি জমির উপর প্রজার অধিকার সরকারিভাবে স্বীকার করে কবুলিয়ত ও পাট্টা -এর প্রচলন করেন। এই ব্যবস্থার ফলে কৃষক ও সরকার উপকৃত হয়।

4. বিচার ব্যবস্থা

দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শেরশাহ শাসন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থাকে শেরশাহ সুশৃংখল করে তোলেন। বিচার ব্যবস্থায় তিনি ফৌজদারি ব্যবস্থার প্রচলন করেন। এই ফৌজদারি ব্যবস্থায় বিচারককে সিকদার বলা হত এবং দেওয়ানী মামলার ভাব ছিল কাজী ও মীর আদলের। সম্রাট নিজে ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। বিচারের ক্ষেত্রে শেরশাহ জাতি, ধর্ম বা ব্যক্তির কোনোরকম বৈষম্য করতেন না।

5. জনকল্যাণমূলক সংস্কার

শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে একটি অন্যতম দিক হল জলকল্যাণমুখী সংস্কার। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেন। তাছাড়া আগ্রা থেকে বারহানপুর এবং লাহোর থেকে সুলতান প্রভৃতি রাজপথ নির্মাণ করেন। তাছাড়া তিনি সর্বপ্রথম ডাক বিভাগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপণ এবং সরাইখানা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছিলেন।

6. সামরিক সংস্কার

সামরিক সংস্কারের ক্ষেত্রে শেরশাহের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আলাউদ্দিন খলজির অনুকরণে শেরশাহ তাঁর সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শেরশাহের সামরিক বাহিনীতে আফগান ও পাঠানদের আধিপত্য থাকলেও সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়।

শেরশাহ সেনাবাহিনীতে দাগ, হুলিয়া এবং ঘোড়ার গায়ে ছাপ প্রথার প্রচলন করেন। তিনি ব্রহ্মজিৎ গৌড় নামক হিন্দু সেনাপতিকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিকগণ শেরশাহের সামরিক ব্যবস্থাকে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।

উপসংহার

সর্বোপরি বলা যায়, শেরশাহ ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রজাহিতৈষী শাসক। তার শাসনকালে অন্তর্দৃষ্টি ও সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই ঐতিহাসিক কিনির মতে – শের শাহ ছিলেন প্রশাসক হিসেবে ইংরেজদের থেকেও দক্ষ। আবার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডক্টর কালিকারঞ্জন কানুনগো – শেরশাহকে আকবরের থেকেও মৌলিক প্রতিভা সম্পন্ন শাসক ও সংগঠক বলে অভিহিত করেছেন। তাই শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারে ও আকবর সহ পরবর্তী মোগল সম্রাটদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • Administrative Reforms of Sher Shah Suri
  • Online Sources

প্রশ্ন – শেরশাহের আসল নাম কি

উত্তর – শেরশাহের আসল নাম হল ফরিদ খান। তিনি তাঁর অসীম সাহসিকতার মাধ্যমে একটি বাঘ শিকার করেছিলেন। তাই তাঁকে শেরশাহ উপাধি দেওয়া হয়। আবার তিনি সুরি বা শূর বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই জন্য অনেকে তাকে শেরশাহ সুরি হিসাবে অভিহিত করেন।

প্রশ্ন – শেরশাহের মৃত্যুর পর কে সিংহাসনে বসেন

উত্তর – শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর দিল্লির সুরি বা শূর বংশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হুমায়ুন দিল্লি দখল করেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

প্রশ্ন – শেরশাহের রাজধানীর নাম কি

উত্তর – শেরশাহের রাজধানীর নাম হল বিহারের সাসারাম এবং এটি পরবর্তীকালে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।

প্রশ্ন – শেরশাহের শাসন ব্যবস্থায় কি কি মানবিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়

উত্তর – শেরশাহের শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন মানসিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন – শেরশাহ গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেছিলেন। তাছাড়া সংবাদ আদান প্রদানের জন্য তিনি প্রথম ডাক বিভাগের প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাস্তার ধারে ধারে বৃক্ষরোপণ করেন। আবার প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি সরাইখানা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছিলেন।

আরোও পোস্ট পড়ুন

Leave a Comment