মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস | History of the Mughal Empire

ভারতবর্ষে প্রায় ৩০০ বছরের সুলতানি শাসনের অবসানের সাথে সাথে মোহম্মদ বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। বাবর মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস (History of the Mughal Empire) ছিল সুদীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী।

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস | History of the Mughal Empire

সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসানের সাথে সাথে মোহম্মদ বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেন। মোগল শব্দটি মঙ্গ শব্দ থেকে এসেছে। মোগলরা বা মুঘলরা মধ্য এশিয়ায় চাখতাই-তুর্কি নামে পরিচিত হলেও ভারতের ইতিহাসে এরা মোগল বা মুঘল বা মোঘল নামে পরিচিত ছিল।

ভারতবর্ষে বহু যুগ ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও আধিপত্য বজায় ছিল। সমকালীন সাহিত্য, বিভিন্ন নথি, মুদ্রা ও স্থাপত্যের নিদর্শন থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য জানা যায়। এখানে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হল –

1. বাবর (১৫২৬ থেকে ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ)

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর দিল্লির কাছে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করেন ও নিহত করেন। এই যুদ্ধে জয় লাভের পর বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে দিল্লি থেকে আগ্রা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার উপর মুঘলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাবর ছিলেন দুর্ধর্ষ তৈমুরলঙের বংশধর এবং তার মাথা ছিলেন মোগল বীর চেঙ্গিস খাঁর বংশজাত। বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জার মৃত্যুর পর মাত্র 12 বছর বয়সে তিনি মধ্য এশিয়ার ফারঘনা রাজ্যের অধিপতি হন। কিন্তু প্রতিবেশীদের শত্রুতার কারণে থেকে বাবর ফারঘনা থেকে বিতাড়িত হন এবং দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে পরিশেষে দিল্লি আক্রমণ করেন।

বাবর ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে মেবারের রাজপুত রানার সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করেন। পানিপথের যুদ্ধের ফলে বাবর মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং খানুয়ার যুদ্ধ জয় লাভের পর মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে।

2. হুমায়ুন (১৫৩০ থেকে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ)

১৫৩০ সালে বাবরের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রথম দফায় ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

কিন্তু সিংহাসনে থাকার সময় হুমায়ুনকে পূর্ব ভারতের শের খাঁ নেতৃত্বে আফগান শক্তি ও গুজরাটের বাহাদুর শাহ এই দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতে হয়।

পরবর্তীকালে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের কনৌজের যুদ্ধে শেরশাহের কাছে হুমায়ুনের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে এবং শেরশাহ দিল্লি সিংহাসন দখল করেন। শেষে রাজ্য হারা হুমায়ুন ভারত ত্যাগ করে পারস্যে আশ্রয় নেয়।

শেরশাহ বুন্দেলখন্দের কালীঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করলে এক বিস্ফোরণে শেরশাহের মৃত্যু হয় (১৫৪৫ সালে)।

3. আকবর (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ)

হুমায়ুন ও শেরশাহের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের পুত্র আকবর মাত্র ১৪ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং নিজেকে ভারত সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু সিংহাসন থেকে আকবর কে বিতাড়িত করার জন্য আফগান নেতা মোঃ আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু দিল্লি ও আগ্রা জয় করেন।

এই অবস্থায় আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ হিমুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমু পরাজিত ও নিয়মিত হন। এই পরাজয় ভারতে আফগান সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন চিরতরে মুছে যায় এবং তিন দশক ব্যাপী মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের পর মুঘল সাম্রাজ্য স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক কালীকিংকর দত্ত বলেছেন – দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি রচনা করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ শুরু হয়।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের পর আকবর সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন। তার সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের ঐক্য ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে আজমির, গোয়ালিয়র ও জৈনপুর জয় করেন। এরপর তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেন ও রাজ্য বিস্তার করেন।

4. জাহাঙ্গীর (১৬০৫ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ)

১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যু পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিম, নুরুদ্দিন মোহম্মদ জাহাঙ্গীর উপাধি গ্রহণ করে দিল্লি সিংহাসনে বসে। পিতার মতো তিনিও রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেন। প্রথম থেকে তিনি মেবারের বিরুদ্ধে এক সামরিক অভিযান পাঠান। ফলে যুদ্ধে মেবারের রানা পরাজিত হয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন।

রাজ্য বিস্তারের ব্যাপারে জাহাঙ্গীর বিশেষ সফল অর্জন না করলেও প্রশাসনের ক্ষেত্রে কিছুটা কৃতিত্ব অর্জন করেন। নিরপেক্ষ বিচারে তিনি পক্ষপাতিত্ব ছিলেন। তাই যে কেউ সম্রাটের বিচারপতি হতে পারতেন। বিচারের ক্ষেত্রে তিনি কিছু নিষ্ঠুর প্রথা বা দন্ড বা শাস্তি প্রথা বন্ধ করেন।

5. শাহজাহান (১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ)

জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় পুত্র খুররম্‌ শাহজাহান উপাধি নিয়ে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে। সিংহাসন লাভের কিছুদিনের মধ্যে শাহজাহান বুন্দেলখন্ড এবং দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহগুলি কঠোর হাতে দমন করেন।

শাহজাহানের সময় বাংলার অত্যাচারী পর্তুগিজদের আধিপত্য ধ্বংস করেন এবং তাদের হুগলিও চট্টগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেন।

শাহজাহানের দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক শান্তি স্থিতিশীলতা বজায় থাকা ছাড়াও বিভিন্ন দিকে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় ভারতবর্ষে বড় কোনো বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। আবার অন্যদিকে বৈদেশিক আক্রমণও মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেনি।

বিশিষ্ট ইতালিয় পর্যটক মানুচি শাহজাহানের রাজত্বকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশেষ প্রশংসা করেছেন।

শাহজাহানের সময় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকার ফলে কৃষি ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প ও স্থাপত্যের চরম উন্নতি ঘটে। ফলে মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের সৃষ্টি হয়।

6. ঔরঙ্গজেব

শাহজাহানের জীবিত কালে দিল্লির সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে বিবাদ বাধে। শেষে ঔরঙ্গজেব দারা, সুজা ও মুরাদকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানকে আগ্রা দুর্গে বন্দী রেখে ঔরঙ্গজেব আলমগীর উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।

সিংহাসনে বসেই ঔরঙ্গজেব রাজ্য বিস্তারে মন দেন। তাঁর নির্দেশে বাংলা শাসনকর্তা মীরজুমলা উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আসাম রাজ্য আক্রমণ করে কিছু অংশ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

প্রায় দুশো বছরের বেশি সময় ধরে মুঘলরা ভারতে রাজত্ব করেছিলেন। তাদের শাসনকালে ভারতের এক উন্নত শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সুবিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণের সূচনা শাহজাহানের আমল থেকে শুরু হয়ে ঔরঙ্গজেবের আমলের শেষের দিকে পর্যন্ত চলতে থাকে এবং ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

উপসংহার

সর্বোপরি বলা যায়, বাবর থেকে শুরু করে, হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর, আকবর, শেরশাহ প্রভৃতি মুঘল রাজাদের দূরদর্শিতা, যুদ্ধ কৌশল ও কূটনীতি মুঘল সাম্রাজ্যকে বিস্তার ও দীর্ঘমেয়াদী করেছিল। ফলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মুঘল সাম্রাজ্য ((History of the Mughal Empire) বিস্তারের সাথে সাথে মোগলরা ভারতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • History of the Mughal Empire
  • Online Sources

প্রশ্ন – মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে

উত্তর – ভারতবর্ষে সুলতানি শাসনের অবসানের পর জহিরউদ্দিন মোহম্মদ বাবর হলেন মোগল বা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।

প্রশ্ন – মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে

উত্তর – মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর।

প্রশ্ন – মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে

উত্তর – মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন হুমায়ূনের পুত্র আকবর। যিনি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

আরোও পোস্ট পড়ুন

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস | History of the Mughal Empire সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment