বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা | Vidyasagar Contribution to Bengali Literature

বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম শিল্পী হিসাবে বিদ্যাসাগর ছিলেন অবিস্মরণীয়। অর্থাৎ আধুনিক যুগে বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান (Vidyasagar Contribution to Bengali Literature) বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করেছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার এক রক্ষণশীল পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও সামাজিক কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। তিনি আট বছর বয়সে বাবার সঙ্গে কলিকাতায় আসেন এবং সেখানে কলকাতায় শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেন। সংস্কৃত বিষয়ে তার অসামান্য পাণ্ডিত্য তাকে বিদ্যাসাগরের পর্যবচিত করে। সংস্কৃতর পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে পারদর্শী। সমাজ সংস্কারক যেমন – বিধবা বিবাহ এবং শিক্ষা সহ নারী শিক্ষার প্রসারে আপামর বাঙালির কাছে তিনি আজও শ্রদ্ধার পাত্র।

বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা | Vidyasagar Contribution to Bengali Literature

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে বাংলা গদ্য সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল তার বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অন্যতম। তাই বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের যথার্থ জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন – “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী। তৎপূর্বে পূর্বে বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বাংলা গদ্যে প্রথম কলা নৈপুণ্যের অবতারণা করেন”।

বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বা বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। অর্থাৎ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বাংলা গদ্য সাহিত্য ভান্ডার সমৃদ্ধশালী হয়। বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করা হলো।

1. মৌলিক রচনা

বিদ্যাসাগর গদ্য সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের পরিচয় দেন তার মৌলিক রচনার মাধ্যমে। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর বিভিন্ন মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

i) সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩ সাল)। এটি বাঙালী প্রণীত সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস।

ii) বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক (১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড ১৮৫৫ সাল)।

iii) বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১ম-১৯৭১, ২য়-খণ্ড ১৮৭৩ সাল)।

iv) বিদ্যাসাগর চরিত (১৮৯১ সাল)। এটি বিদ্যাসাগরের স্বরচিত জীবনী। এটিতে তাঁর স্বরচিত জীবনচরিতে বাল্যকাল পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

v) প্রভাবতী (১৮৬৩ সাল)।

vi) প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৬৩ সাল)। প্রভাবতী সম্ভাষণ’ গ্রন্থটি রচিত হয় বিদ্যাসাগরের বন্ধুকন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুর স্মরণে। ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দে রচিত ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’-হল বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম শোককাব্য।

বিদ্যাসাগরকে অনেকে তাঁর রচনাগুলি নিয়ে নিন্দা করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ছদ্মনাম (কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য) -এ তাদের উত্তর দেয়ার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থ গুলিতে বিদ্যাসাগরের সরস ব্যঙ্গের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়।

i) অতি অল্প হইল (১৮৭৩ সাল)

ii) আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩ সাল)

iii) ব্রজবিলাস (১৮৮৪ সাল)।

2. অনুবাদমমূলক রচনা

বিদ্যাসাগর মৌলিক রচনা পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করেন। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের সময়কালে অনুবাদ সাহিত্যের যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন সংস্কৃত ও ইংরেজি গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে গদ্য সাহিত্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করেন।

i) বাসুদেবচরিত। এটি বিদ্যাসাগরের প্রথম অনুবাদ মূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক রূপে রচিত হয়েছিল। তবে এই বইটি সম্পর্কে কোনো বিশদ তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। ফলে বইটির ভাষা কেমন ছিল তা বর্তমানে জানা যায় না।

ii) বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ সাল)। এটি হিন্দী বেতাল পচচীসী নামক গ্রন্থের অনুবাদ। এই গ্রন্থটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তকরূপে রচিত ও প্রকাশিত হয়।

iii) শকুন্তলা (১৮৬৪ সাল)। এটি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটক অবলম্বনে রচিত হয়।

iv) সীতার বনবাস (১৮৬০ সাল)। এই গ্রন্থটি ভবভূতির উত্তররামচরিত ও বাল্মীকির রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের আখ্যান অবলম্বনে রচিত।

এছাড়া বিদ্যাসাগর বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল –

i) বাঙ্গলার ইতিহাস (১৮৪৮ সাল)। এটি মার্শম্যানের History of Bengal-এর অনুবাদ।

ii) জীবনচরিত (১৮৪৯ সাল) ও আখ্যান মঞ্জুরী। এটি চেম্বার্সের Biographies অনুসরণে রচিত।

iii) বোধোদয় (১৮৫১ সাল)। এটি চেম্বার্সের Rudiment of Knowledge অবলম্বনে রচিত।

iv) কথামালা (১৮৫৬ সাল)। এটি ঈশপস্ ফেবল্স-এর অবলম্বনে রচিত।

v) ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯ সাল)। এটি শেক্সপীয়ারের ‘কমেডি অব এররস’ অবলম্বনে দেশীয় পটভূমিতে রচিত হয়।

3. সামাজ সংস্কারমূলক রচনা

বিদ্যাসাগর তৎকালীন সমাজের যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান হয়েও তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৌত্তিকলতা, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক রচনা বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল।

i) বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬ সাল)।

ii) বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বিরোধিতা (১৮৬০ সাল) ।

iii) বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – ১ম ও ২য় খণ্ড (১৮৫৫ সাল)।

iv) বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (১ম খণ্ড – ১৮৭১ সাল, ২য়খণ্ড-১৮৭৩ সাল)

4. শিক্ষামূলক রচনা

সমাজ সংস্কার রচনার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর বাংলার শিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন। তিনি কলিকাতা, হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুর সহ বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পাশাপাশি শিক্ষার জন্য তিনি বাংলা ভাষায় উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। যা বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছিল। বিদ্যাসাগরের শিক্ষামূলক রচনার মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ গুলি হল –

i) বর্ণ পরিচয় (১৮৫৫)। এটি বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য সহজপাঠের বই, যা বাংলা শিক্ষার প্রসারে বিশেষ অবদান রাখে।

ii) সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১ সাল)।

iii) বোধোদয় (১৮৫১ সাল) প্রভৃতি।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। অর্থাৎ বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তাই শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন – ‘এক্ষণে আমরা বঙ্গ সমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’।

তথ্যসূত্র | Sources

  • বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৩-৫ খন্ড)- সুকুমার সেন
  • বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস- সজনীকান্ত দাস
  • বাংলা সাহিত্যে গদ্য- সুকুমার সেন
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (৬-৯)- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (৩-৪)- ভূদেব চৌধুরী
  • আধুনিক বাংলা কাব্য- তারাপদ মুখোপাধ্যায়
  • উনিশ শতকের গীতিকাব্য- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • বাংলা সাময়িক পত্র- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • আমার কালের কয়েকজন কবি- জগদীশ ভট্টাচার্য
  • রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
  • Internet sources
  • Vidyasagar Contribution to Bengali Literature

প্রশ্ন – আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক কে?

উত্তর – আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যিনি বিভিন্ন মৌলিক গ্রন্থ, অনুবাদমূলক গ্রন্থ, শিক্ষামূলক গ্রন্থ, সমাজ সংস্কারকমূলক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল।

প্রশ্ন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কেন বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়?

উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় কারণ বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে ব্যাকরণগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী করে তোলেন। অর্থাৎ বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের যথার্থ শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরো বলেন – বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে প্রথম কলা নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।

প্রশ্ন – বাংলা গদ্যের আবিষ্কারক কে?

উত্তর – বাংলা গদ্যের আবিষ্কারক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও বিদ্যাসাগরের আগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে বাংলা ভাষার সূচনা শুরু হয়। কিন্তু বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা গদ্য সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দান করেন।

প্রশ্ন – কে বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী?

উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

প্রশ্ন – বিদ্যাসাগরের অপর নাম কি?

উত্তর – বিদ্যাসাগরের অপর নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাই ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরোও পোস্ট পড়ুন

বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা | Vidyasagar Contribution to Bengali Literature সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

close