কোনো সমাজে মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তনের ফলে সমাজ ব্যবস্থার বা রাষ্ট্রের পরিবর্তন সাধিত হয়। তাই বিভিন্ন কারণের মধ্যে ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা (Role of Philosophers in French Revolution) ছিল অভূতপূর্ব।
সমাজ বা রাষ্ট্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা ভাবনা বা মানুষের সংঘটিত আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অনেকের মনে করেন রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী বা দার্শনিকদের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ বুদ্ধিজীবী বা দার্শনিকগণ তাদের লেখনি শক্তির দ্বারা বা চিন্তাশক্তির দ্বারা যুক্তি ও তথ্য সহকারে রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন দোষ ত্রুটি তুলে ধরেন। যা যে কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনকে সূচিত করতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | Role of Philosophers in French Revolution
সমাজে কোনো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে যথেষ্ট প্রতিবাদী সংগঠনের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া যে কোনো ঘুনধরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করতে সংঘটিত আন্দোলনের বিশেষ প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি সমাজে বা রাষ্ট্রের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বা দার্শনিকদের সুচিন্তিত মতামত বিশেষ প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লব ও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের বিভিন্ন দার্শনিকগণ (যেমন – রুশো, মন্তেস্কু, ভলতেয়ার প্রমুখ) তাঁদের চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করেছিলেন। এই সমস্ত দার্শনিকগণ যুক্তি ও তথ্যসহকারে ফ্রান্সের সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনীতির দোষ ত্রুটিগুলি সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরেন। ফলে দার্শনিক তত্ত্বের আলোকে নতুন পথের সন্ধান পেতে ফ্রান্সের শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
ফরাসি বিপ্লবে যে সমস্ত বিশিষ্ট দার্শনিকগণের ভূমিকা কি বা ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা project class 9, তা এখানে আলোচনা করা হল –
1. ভলতেয়ার (১৬৯৪ থেকে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ)
ভলতেয়ার ছিলেন ফ্রান্সের একজন বিশিষ্ট দার্শনিক চিন্তাবিদ। তিনি সর্বদা তার লেখনির মাধ্যমে স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীনতার প্রচার করে থাকতেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Letter Philosophique তে তিনি ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ফ্রান্সের তথাকথিত ধর্মীয় চার্চের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসকে তুলে ধরতেন। যুক্তি ও বিচার বুদ্ধি ছাড়া তিনি কোন কিছুকে গ্রহণ করতেন না।
অর্থাৎ তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে যাজক ও অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তাছাড়া ফ্রান্সের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার তিনি তীব্র বিরোধিতা এবং বিরূপ সমালোচনা করেন। ভলতেয়ারের রচনা পাঠ করে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও চার্চের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়। যা পরবর্তীকালে বিদ্রোহের রূপ নেয়।
2. মন্তেস্কু (১৬৮৯ থেকে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ)
ফ্রান্সের একজন বিশিষ্ট দার্শনিক ছিলেন মন্তেস্কু। তিনি বর্দোর এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘দা স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থে ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থার বিকাশ, বিবর্তন ও পতনের কারণ সমূহ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে স্বৈরাচারের অবসানকল্পে ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেন। তাছাড়া তিনি ফরাসি সমাজ ব্যবস্থা, অভিজাতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিভিন্ন দুর্বলতা ও ত্রুটির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাই মন্তেস্কু ফ্রান্সের দুর্নীতি মূলক সমাজ ব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ করে ফরাসি বাসিকে বিপ্লবী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
3. রুশো (১৭১২ থেকে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ)
ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে যে সমস্ত দার্শনিক অবদান অগ্রগণ্য তাদের মধ্যে অন্যতম হল রুশো। তিনি একদিকে ছিলেন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও অন্যদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। তাই রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রুশো বলেছেন – মানুষ স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু মানুষ সর্বোত্ত পরাধীনতার শৃংখলে বা সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তাই মানুষের আবশ্যিক কর্তব্য হলো সেই সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খল থেকে ছিন্ন করে জন্মগত স্বাধীনতা অর্জন করা।
তিনি তার বিখ্যাত ‘দ্য সোশ্যাল কন্টাক্ট’ গ্রন্থে বলেছেন – আদিম যুগে মানুষের অলিখিত চুক্তির দ্বারা ব্যক্তিবিশেষকে শাসনপদ দান করেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। আর অপরদিকে জনগণ হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাই কোনো শাসক যদি নিজ নিজ কর্তব্য পালনের ব্যর্থ হয় তাকে ক্ষমতায় ছোট করার বৈধ অধিকার আছে মানুষের।
দার্শনিক রুশোর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রচনা সারাদেশে বিশেষত ফরাসি দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং জনগণের ভাব জগতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক কেটালবি বলেছেন – “সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিপ্লব এনেছিল”।
4. ফিজিওক্র্যাট
ফিজিওক্র্যাট নামক অ্যাকশনের অর্থনীতিবিদ আনসার প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁরা মনে করতেন অর্থনীতির একমাত্র উৎস হল ভূমি। দেশের অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তাই দেশের মধ্যে সমস্ত শুল্কপ্রথা তুলে দেয়া উচিত। তাঁরা অবাধ বাণিজ্য নীতির প্রবর্তন করে ফরাসি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। এভাবেই ফরাসি দার্শনিকগণ ফরাসি দেশের মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করেন এবং বিপ্লবকে সংঘটিত করতে সহায়তা করে।
এছাড়া ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা সংক্রান্ত আরোও যে সমস্ত দার্শনিকদের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, হলেন –
i) দার্শনিক মাবলি ফরাসি সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থার বৈষম্যের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রকে স্বাগত জানান
ii) বিশিষ্ট দার্শনিক ডেনিস ডিডেরো ও অ্যালেমবার্ট অমুখো রাষ্ট্র ও চারচের অন্যায়ের কঠোর সমালোচনা করেন।
iii) বিশিষ্ট দার্শনিক জিন মেসলিয়ে ফরাসি চার্চ, রাজতন্ত্র অভিজাতের তীব্র সমালোচনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা (Role of Philosophers in French Revolution) সম্পর্কে বিভিন্ন পন্ডিতের মধ্যে মতভেদ থাকলেও দার্শনিকদের চিন্তা চেতনা সাধারণ মানুষের চিন্তাকে উজ্জীবিত করেছিলেন। তবে আইরিশ রাষ্ট্রবিদ এডমন্ট বার্ক বলেন – ফরাসি বিপ্লবের কারণ হল দার্শনিকদের চক্রান্ত। আবার, জর্জ রুদে বলেছেন – বুর্জোয়াদের প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দার্শনিকদের বক্তব্য তুলে ধরা হতো। এগুলি পাঠ করে সাধারণ মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতিবাদ করার শিক্ষা ও সাহস সঞ্চয় করে। তাই বলা যায়, দার্শনিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা গনমুখী নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা সৃষ্টি করেছিলেন। যা জনমানুষের বিপ্লবী চেতনা আনতে সমর্থ হয়েছিল।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Role of Philosophers in French Revolution
- Online Sources
প্রশ্ন – ফরাসি বিপ্লবের জনক কে?
উত্তর – ফরাসি বিপ্লবের জনক হল জ্যাঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)।
প্রশ্ন – রুশোর পুরো নাম কী ছিল?
উত্তর – রুশোর পুরো নাম ছিল জ্যাঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)।
প্রশ্ন – রুশোর লেখা দুটি গ্রন্থের নাম কী?
উত্তর – রুশোর লেখা দুটি গ্রন্থের নাম হল – The Social Contract (1762)
এমিল (Emile) ও On Education (1762)।
প্রশ্ন – মন্তেস্কু লেখা দুটি গ্রন্থের নাম কী?
উত্তর – মন্তেস্কু লেখা দুটি গ্রন্থের নাম হল – The Spirit of the Laws (1748) ও Persian Letters (1721)।
প্রশ্ন – ভলতেয়ারের প্রকৃত নাম কি?
উত্তর – ভলতেয়ারের প্রকৃত নাম হল – ফ্রাঁসোয়া-মারি আরুয়ে (François-Marie Arouet)।
প্রশ্ন – ভলতেয়ারের লেখা দুটি গ্রন্থের নাম কি?
উত্তর – ভলতেয়ারের লেখা দুটি গ্রন্থের নাম হল – Candide (1759) ও Letters on the English (1733)।
প্রশ্ন – ফরাসি বিপ্লবের দুজন বিখ্যাত দার্শনিকের নাম কী?
উত্তর – ফরাসি বিপ্লবের দুজন বিখ্যাত দার্শনিকের নাম হল – জ্যাঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau) ও মন্তেস্কু।
প্রশ্ন – ভলতেয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ কোনটি?
উত্তর – ভলতেয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হল – Candide (1759)।
প্রশ্ন – মন্তেস্কুর প্রকৃত নাম কি?
উত্তর – মন্তেস্কুর প্রকৃত নাম হল – শার্ল-লুই দ্য সেকন্দা, ব্যারন দ্য লা ব্রেদ এ দ্য মন্তেস্ক্যু (Charles-Louis de Secondat Baron de La Brède et de Montesquieu)
আরোও পোস্ট পড়ুন
- ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | Role of Philosophers in French Revolution
- ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল | Immediate Cause of French Revolution
- নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি লেখ | Napoleon Bonaparte Reforms
- নেপোলিয়নের উত্থান ও পতন | Rise and Fall of Napoleon Bonaparte
- নেপোলিয়নের পতনের কারণ | Downfall of Napoleon Bonaparte
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | Role of Philosophers in French Revolution সম্পূর্ণ পোস্টটি করার জন্য ধন্যবাদ।