বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ। তাছাড়াও বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান (Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature) ছিল অসামান্য।

বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature

আধুনিক যুগের বাংলা গদ্য ভাষার অন্যতম প্রবর্তক হলেন রাজা রামমোহন রায়। তার রচনা অন্যান্যের লেখকদের তুলনায় অনেক সহজ সরল ছিল। তাই গুপ্তকবি বলেছিলেন – “দেওয়ানজি জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন। তাহাতে কোন বিচার বা বিবাদঘঠিত বিষয় লেখার মনের অভিপ্রায় ও ভাব সকল অতি সহজ স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইতো”।

রাজা রামমোহন রায় বেদান্ত, উপনিষদ, মহা নির্মাণ তন্ত্র প্রভৃতি স্বাস্থ্য গ্রন্থের মর্মকথা বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিবৃত করেছিলেন। সেজন্য তিনি অনেক পরিভাষাও ব্যবহার করেছিলেন। রামমোহন সাহিত্যিক নয়, তিনি ছিলেন এদেশের জ্ঞানগুরু এবং স্বাধীন চিন্তার ভগিরথ। তিনি বেদান্ত দর্শনের বঙ্গানুবাদ করেন।

দার্শনিক চিন্তার বাহন হিসাবে প্রথম উচ্চমার্গের শব্দ বন্ধ প্রয়োগে বাংলা গদ্যকে দিন যিনি জনমানষে তুলে ধরেছিলেন তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। অর্থাৎ বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল –

বিতর্কমূলক রচনা

রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন বিতর্কমূলক রচনার মধ্য দিয়ে বাঙালির মন জয় করেছিলেন। বুদ্ধি ও যুক্তির জালে তিনি সামাজিক বৈষম্য, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং সমাজে একাধিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি অসীম সাহসের সঙ্গে তার কলম চালিয়ে যান। তাঁর বিতর্কমূলক রচনার মধ্যে অন্যতম গ্রন্থগুলি হল –

i) ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৮),

ii) বিদ্যা বাগীশের সহিত বিচার (১৮১৮),

iii গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮),

iv) কবিতাকারের সহিত বিচার (১৮২০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

সাহিত্যের অনুবাদ

রামমোহন রায় বাংলা, ইংরেজি, আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। তাই রাজা রামমোহন রায় কেবল বিতর্কমূলক গ্রন্থ রচনা করেননি বরং পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্রকে সাবলীলভাবে অনুবাদ করেছিলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং ধর্মকে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্যই রাজা রামমোহন রায় এই ধরনের রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মশাস্ত্র অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলি হল –

i) বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫),

ii) বেদান্ত সার (১৮১৫),

iii) কেনোপনিষদ (১৮১৬),

iv) ঈশোপনিষদ (১৮১৬),

v) কঠোপনিষদ ও বেদান্ত চন্দ্রিকা প্রভৃতি। এই অনুবাদ গ্রন্থগুলি বাংলায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বিতরণ করে বহু কালের প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের মূলে তিনি কুঠারঘাত করেছিলেন।

রাজা রামমোহন রায়ের গুরুত্বপূর্ণ আলোড়নকারী অনুবাদ গ্রন্থ হল বেদান্ত সার। তিনি এই গ্রন্থের মাধ্যমে খ্রিস্ট ধর্মের বিরোধিতা করে বেদান্ত আশ্রিত একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন।

মিশনারীদের বিরুদ্ধে রচনা

রাজা রামমোহন রায় কেবলমাত্র তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য সমাজ বা তৎকালীন সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নেন নি বরং তিনি ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা মিশনারিদের বিরুদ্ধেও তার কলম তুলে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ মিশনারিদের কাজ কর্মের সঙ্গে বা মিশনারিদের ধর্ম প্রচারে রামমোহনের আপত্তি ও বিরোধিতা তৈরি হয়।

খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দু ধর্মকে ছোট করে তাদের ধর্ম হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা রামমোহন রায় খ্রিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে “The Precepts of Jesus (1820) লিখে শ্রীরামপুর মিশনারিদের রোষে পড়েন। ফলে শ্রীরামপুর মিশনারিরা Friend of India তে রামমোহনের বিরুদ্ধে খ্রিস্ট ধর্মের অজ্ঞতার অভিযোগ তোলেন। এর উত্তরের রাজা রামমোহন রায় খ্রিস্টান জনসাধারণের প্রতি বিখ্যাত তিনটি আবেদন লেখেন।

আবার মিশনারিদের সমাচার দর্পণের বিপরীতে এবং শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান পাদ্রীদের সঙ্গে বাদানুবাদের জন্য রামমোহন ব্রাহ্মণ সেবধি (১৮২১ সাল) ও সংবাদ কৌমুদী (১৮২১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর) নামক দুটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেছিলেন। যা তাকে অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী করে তোলে।

উপসংহার

সর্বোপরি বলা যায়, রাজা রামমোহন রায়ের গদ্য সাহিত্যে অবদান ছিল অসামান্য। তার লেখনি শক্তি, যুক্তিবোধ ও চিন্তাভাবনা তৎকালীন সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ভেঙে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল। তাই রাজা রামমোহন রায় যে গদ্য সাহিত্যের সূত্রপাত করেছিলেন তা পরবর্তী কালের সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। বরং বিভিন্ন বাদপ্রতিবাদে গদ্য সাহিত্যের বিকাশ হয়েছিল।

তথ্যসূত্র | Sources

  • বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৩-৫ খন্ড)- সুকুমার সেন
  • বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস- সজনীকান্ত দাস
  • বাংলা সাহিত্যে গদ্য- সুকুমার সেন
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (৬-৯)- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (৩-৪)- ভূদেব চৌধুরী
  • আধুনিক বাংলা কাব্য- তারাপদ মুখোপাধ্যায়
  • উনিশ শতকের গীতিকাব্য- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • বাংলা সাময়িক পত্র- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
  • আমার কালের কয়েকজন কবি- জগদীশ ভট্টাচার্য
  • রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
  • Internet sources

প্রশ্ন – সতীদাহ প্রথা কে বন্ধ করেছিলেন?

উত্তর – বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় অন্যতম সামাজিক ব্যাধি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছিলেন।

আরোও পোস্ট পড়ুন

বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Ram Mohan Roy in Prose Literature সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

close