পাহাড় কেটে বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের জন্য তৈরি গুহাগুলির মধ্যে অজন্তার গুহাগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অজন্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা (Ajanta Caves Paintings) করলে এর অনেক জানা-অজানা কাহিনী পরিলক্ষিত হয়।
অজন্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা | Ajanta Caves Paintings
অজন্তা গুহাচিত্র বৌদ্ধদের অন্যতম স্থাপত্য কীর্তি। অর্থাৎ হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা এই গুহাচিত্রগুলি চিত্রিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন গুপ্ত সাম্রাজ্য, সাতবাহন সাম্রাজ্য এবং চালুক্য সাম্রাজ্যের সময়ে অজন্তা গুহাচিত্র তৈরি হয়েছিল।
অর্থাৎ আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অজন্তার গুহাচিত্র গুলি চিত্রিত হয়েছিল। তার পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে এই গুহাগুলি জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে এবং লোক চক্ষুরঅন্তরালে চলে যায়। অজান্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা (Ajanta Caves Paintings) করলে এর পরিসর শেষ হবার নয়। এখানে অজন্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি তুলে ধরা হলো।
1. অজন্তা গুহাচিত্রের অবস্থান
অজান্তা হলো গুহানগরী। ছোট বড় মিলিয়ে মোট এখানে ৩০ টি গুহার সন্ধান পাওয়া যায়।অজান্তা গুহাচিত্র ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের অন্তর্গত ঔরঙ্গাবাদ জেলায় অবস্থিত।
সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে অজন্তার গুহাগুলি অর্ধচন্দ্রাকারে অবস্থিত। পাহাড়ের গায়ের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে হয়। এই গুহাগুলির নিচে বাঘোরা নদী বয়ে গেছে।
Ajanta Caves Paintings Picture
2. অজন্তা গুহাচিত্রের আবিষ্কার
শতাব্দীর পর শতাব্দি লুকিয়ে থাকা অজন্তা গুহাচিত্রের আবিষ্কার একপ্রকার রহস্যাবৃত ও রোমাঞ্চকর। সুদীর্ঘ সময় ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অজন্তা গুহাচিত্রে অনবদ্য কীর্তি ১৮১৯ সালে আবিষ্কৃত হয়।
১৮১৯ সালের মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জন স্মিথ সেনাদল নিয়ে বাঘোরা নদী সংলগ্ন জঙ্গলে শিকার করতে আসেন। এই সময় নদীর ওপারে পরিত্যক্ত গুহাস্তূপ ও ভাঙ্গা খিলান তাদের নজরে আসে। এরপর তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টি জানান এবং এটি রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক রিপোর্টে প্রথম প্রকাশ পায়।
মাঝখানে আরো ১০০ বছর পেরিয়ে যায়। এর মধ্যে গুহা গুলিতে চোর-ডাকাতের উপদ্রব অন্যান্য মানুষদের যাতায়াতের ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকলা নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালে হায়দ্রাবাদের নিজাম গুহাচিত্র গুলো সংরক্ষণের জন্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ চালু করেন।
3. অজন্তা গুহাচিত্রের বিশেষত্ব
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনার জন্য অজন্তা গুহাচিত্র গুলি নির্মিত হয়েছিল। অসংখ্য শিল্পী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বহু বছরের প্রচেষ্টার ফলে এই অপরূপ শিল্পকর্ম অজন্তা গুহাচিত্রে ফুটে উঠেছিল।
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন অজন্তার গুহাচিত্র গুলি দুটি পর্বে নির্মিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রাজা বিম্বিসারের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তৃত লাভ করে এবং তা পরবর্তীকালে তৃতীয় শতকের সম্রাট অশোকের আমলে আরো বিস্তৃত লাভ করে।
তাছাড়া পরবর্তীকালে সম্রাট কনিষ্কের সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম হীনযান এবং মহাযান বেড়ে যাবে। এই দুই দলে ভাগ হয়ে যায়।
অজান্তা গুহাচিত্রকলার মূল বিষয়বস্তু
অজান্তায় মোট ৩০ টি গুহার সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান আমলের গুহাগুলি দুপ্রান্তে ক্রমশ মহাযান যুগের নবীনতর গুহাগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ৩০ টি গুহার মধ্যে পাঁচটি চৈত্য বা প্রার্থনা বা উপাসনা গৃহ যথা – ৯, ১০, ১৯, ২৫ ও ২৯ নম্বর গুহা।
বাকি ২৫ টি গুহা হলো বৌদ্ধ বিহার বা বৌদ্ধ শ্রমণদের বিশ্রাম স্থল বা বসবাস গৃহ।
অজান্তা গুহাচিত্রের মূল বিষয়বস্তুগুলি বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিকগণ তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা –
প্রথমত – একক চিত্র। যেমন – দোলনায় এক নারী মূর্তির চিত্র, নরনারীর যুগল মূর্তি। আবার গুহার ছাদে চিত্রিত সুন্দর নকশা ও নারী মূর্তি প্রভৃতি।
দ্বিতীয়ত – কাহিনী চিত্র। এই চিত্রের মধ্যে অন্তর্গত বুদ্ধদেবের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, জাতক কাহিনী প্রভৃতি এবং
তৃতীয়ত – নকশা চিত্র। এই চিত্রের মধ্যে অন্তর্গত হল বিভিন্ন ফুল, পশু পাখি প্রভৃতি।
তাছাড়া শ্রমণদের থাকার ঘরগুলিও আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো ছিল। ঘরের দরজা সংকীর্ণ এবং কারুকার্য যুক্ত। ঘরের মধ্যে দুপাশে পাথরেরর কঠিন সজ্জা যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুকেরা বিশ্রাম নিতেন। এই গুহাচিত্র এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল যে সারাদিন সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকতো। এই পর্বতশ্রেণী এমন যা অর্ধচন্দ্রাকৃতভাবে বিস্তৃত ছিল।
দ্বিতীয় শতকে সাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে ৮, ৯, ১০ এবং ১২ নম্বর গুহা গুলি তৈরি হয়। সেই সময় বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণের প্রচলন ছিল না। বুদ্ধদেবের প্রতিক হিসাবে পদ্মফুল, স্তুপ এবং ধর্মচক্র ব্যবহৃত হতো।
বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান সম্প্রদায় বা থেরবাদী বৌদ্ধরা জ্ঞানমার্গে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তারা স্তূপ নির্মাণ করে প্রার্থনা করতেন।
আবার বুদ্ধের মূর্তি কল্পনা বা খোদায় শুরু হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় এবং সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্মে মহাযান সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় এবং এই সম্প্রদায় ছিলেন ভক্তিমার্গে বিশ্বাসী।
Ajanta Caves Paintings
অজান্তা গুহাচিত্রে ব্যবহৃত উপাদান
আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে চিত্রিত অজন্তা গুহাচিত্র (Ajanta Caves Paintings) -র শিল্পকলা অনেকটা অক্ষত রয়েছে। গুহাচিত্রগুলিতে তুষের গুঁড়ো, চুন, ভুষাকালি, গ্রিন রক, গোমল ইত্যাদি চিত্র অংকনের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আবার অধিকাংশ স্থাপত্য পাথর কেটে বা খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে।
4. অজান্তা গুহাচিত্রের দৈন দশা
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন আনুমানিক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে পল্লবদের সাথে দ্বিতীয় পুলকেশী যুদ্ধ বাধে এবং সেই যুদ্ধের দ্বিতীয় পুলকেশী নিহত হন এবং সেই সময় থেকে অজান্তা রাজ অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
পরবর্তীকালে অজন্তা গুহা থেকে শিল্পী এবং গুহাবাসি বৌদ্ধ ভিক্ষুকেরা অন্যত্র চলে যান। ফলে অজন্তা গুহা জনশূন্য হয়ে পড়ে ও ঘন অরণ্যে ঢেকে যায় এবং দীর্ঘদিন এই অসামান্য শিল্পকলা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায়।
5. ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
সারা বিশ্বে অজন্তা গুহাচিত্রের শিল্পকর্ম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালে অজন্তার গুহাচিত্রগুলি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান বা হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষিত করা হয়।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, অজন্তা গুহাচিত্র (Ajanta Caves Paintings) বৌদ্ধদের দ্বারা নির্মিত একটি স্থাপত্য যা আবিষ্কারের পর বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল লোকালয় থেকে দূরে নিভৃতে সাধনার জন্য এই অজন্তা গুহা বেছে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি তারা তাদের সাধনার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন রূপের সাধনাকে যার ফলশ্রুতি হিসেবে অজন্তা গুহাচিত্রের শিল্প সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। তাই ভারতীয় ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক জীবনের এক বর্ণময় ইতিহাস সুদীর্ঘকাল ধরে লুকিয়ে রয়েছে অজান্তা গুহাচিত্রে।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Discuss about Ajanta Cave Paintings in brief essay.
- Online Sources
প্রশ্ন – অজন্তা গুহাচিত্র প্রধান বৈশিষ্ট্য
উত্তর – অজন্তা গুহাচিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর অসামান্য শিল্পকলা ও চিত্রকলা। হাজার হাজার শিল্পী ও বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান এই অজান্তা গুহাচিত্র। যা আবিষ্কারের পর সারা বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল এবং শিল্প সৌন্দর্যে মুগ্ধ করেছিল।
প্রশ্ন – অজন্তা গুহা কে নির্মাণ করেন
উত্তর – কে বা কারা অজান্তা গুহা এবং চিত্রগুলি নির্মাণ করেছিলেন তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না পাওয়া গেলেও গুহা চিত্র থেকে ঐতিহাসিকবীদগণ মনে করেন এগুলো বৌদ্ধদের স্থাপত্য কীর্তি। তাছাড়া অজন্তা গুহাচিত্রে বুদ্ধদেবের জীবন বৃত্তান্তের ছবিগুলি ও বিভিন্ন ঘটনাগুলি থেকে মনে করা হয় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুকেরা অজন্তা গুহা নির্মাণ করেন।
প্রশ্ন – অজন্তা কোথায় অবস্থিত এটি কেন বিখ্যাত
উত্তর – অজন্তা বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের অন্তর্গত ঔরঙ্গাবাদ জেলায় অবস্থিত। এটি বিখ্যাত কারণ এখানে বৌদ্ধদের উপাসনাস্থল ছিল। তাছাড়া এই অজন্তা গুহাগুলিতে পাথরের গায়ে খোদাই করা ও চিত্রিত অপরূপ কারুকার্যের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে আছে।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum
অজন্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা | Ajanta Caves Paintings সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।