এক সাধারণ সৈনিক থেকে পরবর্তীকালে তার অসাধারন কৃতিত্ব ও দক্ষতার ফলে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সম্রাট হন। কিন্তু কালের নিয়মে বিভিন্ন কারণে নেপোলিয়নের পতন (Downfall of Napoleon Bonaparte) অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ফরাসি বিপ্লবের সময় নেপোলিয়নের প্রতিভা ও ক্ষমতার ফলে উত্থান ঘটে। ইউরোপের বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলিও নেপোলিয়নের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কালের নিয়মে বিভিন্ন কারণে মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এখানে নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
নেপোলিয়নের পতনের কারণ | Downfall of Napoleon Bonaparte
নেপোলিয়নের পতনের কারণ হিসাবে কোন একটি সুনির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিতকরণ করা যায় না। বিভিন্ন কারণ ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের পতনকে সংগঠিত করেছিল।
নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলির পশ্চাতে যে সমস্ত দিকগুলি পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
1. স্বৈরাচারী শাসন
ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। অর্থাৎ তিনি ইউরোপের জনগণকে স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দিলেও নিজেই বিজিত রাজ্যসমূহে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করেছিলেন।
যার ফলে ইউরোপের জনগণ স্বৈরাচারী শাসক নেপোলিয়নের উপর ক্ষুদ্র হয়েছিলেন। তাছাড়া নেপোলিয়নের বিভিন্ন দমন মুলক নীতি যেমন – ফরাসিদের বাগ স্বাধীনতা হরণ, সাম্রাজ্যের সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ, জনগণকে বিনা বিচারে আটক প্রভৃতি জনগণের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।
2. উচ্চাকাঙ্ক্ষা
নেপোলিয়নের পতনের কারণ হিসাবে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দায়ী করা হয়। একের পর এক সাফল্য লাভের ফলে নেপোলিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরো বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়।
ফলে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অন্যতম দিক হল মস্কো অভিযান। তাই সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেপোলিয়ান সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
3. মস্কো অভিযান
নেপোলিয়ান বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মস্কো অভিযান করেছিল। কারণ মস্কো মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জাতীয়তাবাদের উদ্বুদ্ধ মস্কো জনগণের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধে অসংখ্য ফরাসি সেনা ও সেনাপতিগণের মৃত্যু হয়।
এর ফলে নেপোলিয়নের মস্ক অভিযান ব্যর্থ হয়। মস্কো অভিযানের ব্যর্থতার ফলে নেপোলিয়নের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছিল।
4. মহাদেশীয় অবরোধ
ইংল্যান্ডের সাথে সরাসরি যুদ্ধে পেরে না উঠে নেপোলিয়ন অর্থনৈতিক দিক থেকে ইংল্যান্ডকে পঙ্গু করার নীতি নিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু মস্কো এই মহাদেশে অবরোধ মেনে নেয়নি।
নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধের ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আর্থিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে এইসব দেশগুলি নেপোলিয়ন বিরোধী হয়ে পড়ে।
তাছাড়া মহাদেশীয় অবরোধের ফলে নেপোলিয়ানকে বিভিন্ন যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম হল মস্কো অভিযান ও গেরিলা যুদ্ধ।
5. পোপের প্রতি দুর্ব্যবহার
ইতালি অভিযানের সময় নেপোলিয়ান পোপের রাজ্য অন্যায়ভাবে অধিকার করে নিয়েছিল এবং তাকে বন্দী করে ফ্রান্সে নিয়ে আসেন। পোপের প্রতি দুর্ব্যবহারের ফলে ক্যাথলিক জনগণ নেপোলিয়নের উপর ক্ষুব্ধ হন। এই ঘটনা নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিতকে অনেকাংশে দুর্বল করে দিয়েছিল।
6. ইংল্যান্ডের নৌ শক্তি
নেপোলিয়নের রাজ্য বিস্তার নীতি ও মহাদেশীয় অবরোধের ফলে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে চলে যায়। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের নৌশক্তি ছিল বিশ্বশ্রেষ্ঠ। ইংল্যান্ডের নৌ শক্তিকে পরাজিত করার মত ক্ষমতা ফ্রান্সের ছিল না।
ফলে নীল নদের যুদ্ধ ও ট্রাফালগারের যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌ শক্তির কাছে নেপোলিয়নের ফরাসি নৌ শক্তি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিল। এর ফলে নেপোলিয়নের পতন ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়।
7. স্পেনীয় ক্ষত
নেপোলিয়ন অন্যায় ভাবে ক্ষমতার বলে স্পেন দখল করেন এবং নিজের ভাই জোসেফকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু এর ফলে স্পেনীয় জনগণ এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীকালে তারা পর্তুগালের সঙ্গে একত্রিত হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
এই যুদ্ধ দীর্ঘ ছয় বছর ধরে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে নেপোলিয়নের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। পরবর্তীকালে নেপোলিয়ান দুঃখ করে বলেছিলেন – পেনীয় ক্ষতই আমার সর্বনাশ করেছে।
8. ইউরোপের শক্তি জোট
নেপোলিয়নের বিভিন্ন সাম্রাজ্যগ্রাসি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ইউরোপের রাষ্ট্রশক্তি জোট গঠিত হয়। অর্থাৎ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপের শক্তিবর্গের রাষ্ট্র জোট ফ্রান্সের সামরিক শক্তিকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
তাই ইউরোপের প্রায় সকল বৃহৎ শক্তি অস্ত্র ধারণ করে নেপোলিয়নের সামরিক পরিকল্পনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছিল। অর্থাৎ ১৮১৫ সালের ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন চূড়ান্তভাবে পরাজিত এবং সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাচিত হন।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, নিজের প্রতিভা ও ক্ষমতার সাহায্যে নেপোলিয়ান বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও বিভিন্ন কারণে নেপোলিয়নের পতন সংঘটিত হয়। অর্থাৎ নেপোলিয়নের পতনের কারণ হিসেবে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিতকরণ করা যায় না। প্রতিটি কারণে কম বেশিভাবে দায়ী ছিল। তবে যাই হোক পরাক্রমশালী নেপোলিয়ানের ফরাসি সাম্রাজ্য 15 বছরের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তথ্যসূত্র (Sources)
- Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
- Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
- Downfall of Napoleon Bonaparte
- Online Sources
প্রশ্ন – নেপোলিয়নের পতনের জন্য কোন শক্তি দায়ী ছিল
উত্তর – নেপোলিয়নের পতনের জন্য ইংল্যান্ডের নৌ শক্তি এবং ইউরোপের শক্তি জোট অনেকাংশে দায়ী ছিল। অর্থাৎ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপের শক্তিবর্গের রাষ্ট্র জোট ফ্রান্সের সামরিক শক্তিকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
প্রশ্ন – নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের কারণ
উত্তর – নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক সাধারণ সৈন্য থেকে ফ্রান্স সম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তার সাম্রাজ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের কারণ গুলি হল – অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আগ্রাসী মনোভাব, মহাদেশীয় অবরোধ, স্বৈরাচারী শাসন, ফ্রান্সের জনগণের বাক স্বাধীনতা হরণ, মস্কো অভিযান, সেনাবাহিনীদের দুর্বলতা, স্পেনীয় ক্ষত, ইউরোপীয় শক্তি জোট প্রভৃতি।
আরোও পোস্ট পড়ুন
- লেখ্যাগারের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ | 8 Main Types of Archives
- লেখ্যাগারের কার্যাবলী আলোচনা | Function of Archives in History
- লেখ্যাগার বা মহাফেজখানা কাকে বলে | Archives in History
- সংগ্রহশালার গুরুত্ব আলোচনা করো | 10 Importance of Museum
- সংগ্রহশালার প্রদর্শন নীতি আলোচনা করো | 10 Museum Exhibition Policy
- সংগ্রহশালার কার্যাবলী আলোচনা | 8 Main Function of Museum