সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল | Causes and Effects of Revolt of 1857

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ (Revolt of 1857) সংঘটিত হয়েছিল।

সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল | Causes and Effects of Revolt of 1857

১৭৫৭ সালের ইংরেজদের বিরুদ্ধে পলাশী যুদ্ধের পর একশ বছর পর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ একত্রে যে যুদ্ধ সংঘটিত করেছিল, সেটি সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত। এখানে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল গুলি আলোচনা করা হল –

সিপাহী বিদ্রোহের কারণ বা মহাবিদ্রোহের কারণ

ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রিটিশদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ। তবে ইংরেজ শাসনকালে বিভিন্ন বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও এই সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ সিপাহী বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করেছেন। সাধারণভাবে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ বা মহাবিদ্রোহের কারণ গুলি হল নিম্নলিখিত –

1. রাজনৈতিক কারণ

ইংরেজ শাসনকালে রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণ দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মধ্যে বিদ্রোহে সূচনা করেছিল। যেমন – লর্ড ডালহৌসীর প্রবর্তিত ‘ স্বত্ববিলোপ নীতি’ ঝাঁসি, নাগপুর, সাতারা প্রভৃতি রাজ্যগুলিকে গ্রাস করা হয়। তাছাড়া তাঞ্জোর ও কর্ণাটকের রাজ পরিবার এবং পেশোয়া পুত্র নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এইভাবে যে সমস্ত দেশীয় রাজ্যকে ইংরেজরা অধিকার করে নিয়েছিল সেখানে বহু মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে জীবিকা হীন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন করে বসে এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে বা মহাবিদ্রোহে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

2. সামাজিক কারণ

সামাজিক বিভিন্ন কারণে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। যেমন – ইংরেজিদের ব্যবহার বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শাসক এবং সমাজের সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরাট ব্যবধান তৈরি করেছিল। তাছাড়া ভারতীয়রা ইংরেজদেরকে কখনোই শাসক বলে মনে করতেন না।

3. অর্থনৈতিক কারণ

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ সিপাহী বিদ্রোহের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ এক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, যেমন –

প্রথমত – ইংরেজ শাসনকালে অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের আগে ১০০ বছর ধরে ইংরেজরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী তাদের দেশ (ইংল্যান্ড) নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে ভারতীয়দের তথা ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে।

দ্বিতীয়ত – শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংরেজিরা ভারতবর্ষকে কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসাবে পরিণত করলে দেশীয় শিল্প গুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং দেশীয় বণিক, ব্যবসায়ী, কারিগর, শ্রমিকরা সকলেই আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে।

তৃতীয়ত – ইংরেজিদের দ্বারা প্রবর্তিত নতুন ভূমির রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে জনগণের উপর বিরাট পরিমাণ করের বোঝা চাপানো হতো। এর ফলে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। যা বিদ্রোহকে দ্রুত সংগঠিত করেছিল।

চতুর্থত – ইংরেজি শিক্ষার ও ইংরেজি ভাষার প্রাধান্যর ফলে দেশীয় শিক্ষিত যুবকরা বেকার হয়ে পড়েছিল এবং তাদের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে তারা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।

পঞ্চমত – লর্ড ক্লাইভ -এর দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে। ফলে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হয়।

মহাবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

4. ধর্মীয় কারণ

সিপাহী বিদ্রোহের একটি অন্যতম কারণ হল ধর্মীয় কারণ। ইংরেজ শাসনকালে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারীরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার এর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের পদার্পণ করেছে এবং তারা ভারতের বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন এবং অনেককে ধর্মান্তরিতও করেন।

তাছাড়া সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহ প্রচলন প্রভৃতি ইংরেজদের ষড়যন্ত্র বলে ভারতীয়রা মনে করতেন। ফলস্বরুপ ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত পড়ে ও বিদ্রোহের সূচনা হয়।

5. প্রত্যক্ষ কারণ

প্রত্যক্ষ বিভিন্ন কারণে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল যেমন – ইংরেজ সরকার এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন করেন এবং সেই রাইফেল কার্তুজ দিয়ে চালাতে হতো। এই কার্তুজ দাঁত দিয়ে কেটে তবে ব্যবহার করতে হতো। কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যেগুজব রটে এই কার্তুজ গরু বা শুয়োরের চর্বি দিয়ে তৈরি ফলে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ধর্মে আঘাত ঘটে। ক্রমে এই বিদ্রোহ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

তাছাড়া ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডে নামে একজন সিপাহী এক ইংরেজ অফিসারকে হত্যা করলে মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়।

6. সামরিক কারণ

ব্রিটিশদের সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ সিপাহী বৃদ্ধের অন্যতম কারণ। অর্থাৎ ইংরেজ সিপাহীদের তুলনায় ভারতীয় সিপাহীরা কম বেতন পেত।

তাছাড়া অভিজ্ঞ ভারতীয় সিপাহীদের তুলনায় কম অভিজ্ঞ ইংরেজ সিপাহীরা পদোন্নতি লাভ করত। ফলে ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজদের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকে এবং ব্রিটিশ শাসনের উপর অশ্রদ্ধ্যার ফলে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হয়।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রিটিশদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে ও ব্রিটিশদের বিভিন্ন নিয়ম-নীতির বিরোধিতার (বিশেষত ব্রিটিশদের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য) কারণে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।

তথ্যসূত্র (Sources)

  • Allaby, R. G. (2016) “Evolution .“Encyclopedia of Evolutionary Biology”. Ed. Kliman, Richard M. Oxford: Academic Press,19–24.
  • Boyd, Brian. (2017) “Archaeology and Human-Animal Relations: Thinking through Anthropocentrism.” Annual Review of Anthropology 46.1, 299–316. Print.
  • Online Sources

প্রশ্ন – 1857 খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ

উত্তর – 1857 খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ বিভিন্ন ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হল – রাজনৈতিক কারণ, সামরিক কারণ, ব্রিটিশদের বৈষম্য মূলক আচরণ, ব্রিটিশদের অত্যাচার, অর্থনৈতিক কারণ প্রভৃতি।

প্রশ্ন – সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতের বড়লাট কে ছিলেন?

উত্তর – সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতের বড়লাট বা ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ক্যানিং। 1856 সাল থেকে 1852 সাল পর্যন্ত লর্ড ক্যানিং ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন।

আরোও পোস্ট পড়ুন

Leave a Comment